নয়া দিল্লি: পুজোর ছুটিতে অনেকেরই ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল হিমাচল প্রদেশ বা উত্তরাখণ্ডের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে। পরিকল্পনামাফিক টিকিটও কাটা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গোটা পরিকল্পনাকেই অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে দুই পাহাড়ি রাজ্যের দুর্যোগ। হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড দেখছে প্রকৃতির রুদ্ররূপ। একটানা প্রবল বৃষ্টি আর ধসে বিধ্বস্ত হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত দুই রাজ্যই। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে একের পর এক বাড়ি, ফুঁসছে পাহাড়ি নদী। দুই রাজ্যে বিগত চারদিনের বিপর্যয়েই মৃতের সংখ্যা প্রায় একশো ছুঁইছুঁই।
হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড জুড়ে ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে প্রকৃতি। শনিবার রাত থেকে শুরু হয়েছে মুষলধারে লাগাতার বৃষ্টি। ভারী বৃষ্টির জেরে যেমন ছাদ ভাঙছে, তেমনই আবার পাহাড়ের মাটি আলগা হয়ে ধস,হড়পা বানও নামছে। গত জুলাই মাসেও একই পরিস্থিতি হয়েছিল দুই রাজ্যে। সেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা যায়নি, তার আগেই ফের বিপর্যয়। কিন্তু কেন এমন রোষ প্রকৃতির?
দুই পাহাড়ি রাজ্যেই বন্যা পরিস্থিতি। সেটা না হয় তবু সামলে নেওয়া যেত। কিন্তু এবার প্রবল বৃষ্টি ও বন্যার পাশাপাশি প্রবল ধসও নেমেছে। সবকিছু ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। ঘরবাড়ি, দোকান, কারখানা, বিদ্যুতের খুঁটি – ধসের মুখে সবটাই খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে। হিমাচলে দুটি জেলায় ধস নেমে যোগাযোগ বন্ধ। উত্তরাখণ্ডের জোশীমঠ সহ ধসপ্রবণ এলাকাগুলিতে প্রাণ হাতে নিয়ে বাস করছেন হাজার হাজার মানুষ। গত বছরই প্রবল ধস, বাড়িতে ফাটলের কারণে এদের অনেকে ঘরছাড়া হয়েছিলেন। অন্তত ১০০ পরিবার এখনও বাড়ি ফিরতে পারেনি।
সহজ কথায় বলতে গেলে, এতদিন ঈশ্বরের সৃষ্টির সঙ্গে ছিনিমিনি খেলেছে মানুষ। এবার পালা প্রতিদানের। প্রকৃতির উপর মানুষ যে নির্বিচারে অত্যাচার চালিয়েছে, তা গুনে গুনে ফেরত দিচ্ছে। পাহাড়ে বেলাগাম খোদাই, পাথর কেটে নির্মাণ কাজ চলছে। নতুন রাস্তা তৈরি বা পুরনো রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য পাহাড়ের পর পাহাড় ও তার কোলে থাকা গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে। অন্যদিকে, নদীতেও বাঁধ বসিয়ে জলবিদ্যুৎ, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। নদীর গতিপথ সরু করে, সেই জমি জবর দখল করে গজিয়ে উঠছে বিলাসবহুল রিসর্ট।
Massive Landslide opposite Main Gate of AIIMS Bilaspur, Himachal Pradesh.#HimachalPradesh #Landslide #Mandi #Shimla #Pandoh #Flood #Floods pic.twitter.com/Cym4wwaEgd
— Anil Kumar Verma (@AnilKumarVerma_) August 12, 2023
এবার সেই দখল হওয়া জমিই পুনরুদ্ধার শুরু করেছে পাহাড়ি নদীগুলি। বিপাশা হোক বা অলকানন্দা, ভরা বর্ষায় ফুঁসছে। জল বাড়তেই তা রাস্তাঘাট গিলে খাচ্ছে, ফিরিয়ে নিচ্ছে পুরনো গতিপথ। এদিকে, যত্রতত্র নির্মাণ ও পাহাড় কেটে ফেলার কারণে মাটি আলগা হয়ে গিয়েছে, যার ফলে অল্প বৃষ্টিতেও ধস নামছে।
Unimaginable aftermath of Himachal floods ,Landslides bury construction equipment, roads wiped out, like here at 7 Mile. Extensive time needed to revive these road sections on the Manali-Chandigarh route. #HimachalDisaster #HimachalPradesh pic.twitter.com/wwn0OfbQXC
— Nikhil saini (@iNikhilsaini) August 17, 2023
এ তো গেল মানবসৃষ্ট কারণ। এবার আসা যাক আবহাওয়ার প্রসঙ্গে। হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড সহ হিমালয়ের পাদদেশের রাজ্যগুলিতে কেন অতিবৃষ্টি হচ্ছে? এই বিষয়ে মৌসম ভবনের তরফে জানানো হয়েছে, প্রতি বছরই বর্ষার সময়ে একটি নিম্নচাপ অঞ্চল তৈরি হয়, একে মনসুন ট্রাফ বলে। এটি এবার স্বাভাবিক অবস্থানের তুলনায় উত্তরে অবস্থান করছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হিমাচলের পাদদেশে নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে, যার জেরে উত্তরের পাহাড়ি রাজ্যগুলিতে অতিরিক্ত পরিমাণে বৃষ্টি হচ্ছে। গোঁদের উপরে বিষফোঁড়ার মতো একটি পশ্চিমী ঝঞ্চা ভূমধ্য সাগরে তৈরি হয়েছে এবং তা ভারতীয় উপমহাদেশে বৃষ্টি বয়ে আনছে।
ক্লাউড বার্স্ট বা মেঘভাঙা বৃষ্টি পশ্চিম হিমালয়ের পাদদেশে নতুন কোনও ঘটনা নয়। আবহবিদদের মতে, এক ঘণ্টার মধ্যে যদি ১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ১০ সেন্টিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টি হয় তাহলে তাকে মেঘভাঙা বৃষ্টি বলা যায়। হিমালয় পর্বতমালার নৈকট্য এবং তার পাদদেশের রাজ্যগুলির অবস্থানগত কারণে এখানে এমন ঘটনা প্রায় প্রতি বছরই হয়। কেদারনাথের বিপর্যয়ও এই মেঘ ভাঙা বৃষ্টির কারণেই হয়েছিল। তবে এবারের মতো এত ঘনঘন মেঘ ভাঙা বৃষ্টি ইদানিংকালে হয়নি। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পাহাড়ি এলাকায় যে গাছগাছালির জঙ্গল এতদিন জলের তোড় আটকাত, ধস প্রতিরোধ কমত, সেই সমস্ত গাছ নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়েছে। তবে সেটাই কী একমাত্র কারণ নাকি এর পিছনে রয়েছে বিশ্বায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব?
বিজ্ঞানীরা ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের সঙ্গে ইউরোপের বিস্তীর্ণ এলাকার তুলনা করেছেন। বিশ্বের দুই ভৌগলিক এলাকাকে একসূত্রে বেঁধেছেন। বিজ্ঞানীদের মতে, ইউরোপ যেভাবে গরমে পুড়ছে আর হিমালয় পাদদেশে যেভাবে বন্যা ও ভাঙন বাড়ছে, সেটা একই সুতোয় বাঁধা। দুটোই গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্বায়নের কুফল।