কলকাতা: দীর্ঘ টালবাহানার পর অবশেষে হতে চলেছে পঞ্চায়েত নির্বাচন(Panchayat Election 2023)। কিন্তু নির্বাচনের আগেই চরমে পৌঁছেছে অশান্তি। ভোটের আগে এই অশান্তি নিয়ে আদালতের তীব্র ভৎসর্নার মুখে পড়েছে রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের কমিশনারের ভূমিকা নিয়েও উঠেছে হাজারো প্রশ্ন। কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে রাজীব সিনহাকে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনী (Central Force) নামানো থেকে শুরু করে রাজ্যপালের তলবকেও যেভাবে নানা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গিয়েছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার, তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। মামলা গড়িয়েছে আদালত অবধি। বুধবারই কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানম তীব্র সমালোচনা করেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহার। কমিশনের নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করে প্রধান বিচারপতি বলেন, “যদি চাপ সামলাতে না পারেন, তবে দায়িত্ব ছেড়ে দিন, রাজ্যপাল নতুন কমিশনার নিয়োগ করবেন”। একই সঙ্গে ফের একবার উল্লেখ করা হয় প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি এন শেষণের কথাও। আদালতের তরফে বলা হয়, “নির্বাচনের ক্ষেত্রে কমিশনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই কারণেই মামলার প্রথম দিনেই প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টিএন শেষণের (TN Seshan) কথা উল্লেখ করা হয়েছিল“। এবার প্রশ্নটা হল, কে এই টিএন শেষণ। কেনই বা তাঁর কথা বারবার উল্লেখ করা হচ্ছে নির্বাচন আবহে?
দেশের নির্বাচনের ইতিহাস সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল, তাদের কাছে টিএন শেষণের নাম খুবই পরিচিত। নির্বাচন কমিশনের কী ভূমিকা হওয়া উচিত, তা নিয়ে বহু সময়েই বিভিন্ন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আদালত, সুপ্রিম কোর্টেও টিএন শেষণের নাম উল্লেখ করা হয়। উদাহরণ হিসাবে ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্টে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে কলোজিয়াম ব্যবস্থার আর্জির শুনানিতে বিচারপতি কেএম জোসেফের বেঞ্চের তরফে বলা হয়েছিল, “অগুনতিবার মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু টিএন শেষণের মতো কমিশনার একবারই হয়। দুই নির্বাচন কমিশনার ও একজন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার- তিন তিনজনের কাঁধে বিরাট দায়িত্ব দেওয়া রয়েছে। সেই কারণে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা উচিত।”
তিরুনেল্লাই নারায়ণ আইয়ার শেষণ বা টিএন শেষণকে ১৯৯০-র দশকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ১১ ডিসেম্বর অবধি তিনি মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই ছয় বছরের মেয়াদকালেই তিনি এমন বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছিলেন, যা ভারতীয় নির্বাচন ব্যবস্থাকেই বদলে দিয়েছিল।
কোনও ধরনের বেনিয়ম বরদাস্ত করতেন না টিএন শেষণ। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসের এক রাতে তাঁর বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর হাত দিয়েই টিএন শেষণের কাছে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হওয়ার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। প্রথমে সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিলেন টিএন শেষণ। পরে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। কংগ্রেস নেতা তাঁকে এই প্রস্তাব গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। বৈঠক শেষে টিএন শেষণ যখন বেরিয়ে আসছিলেন, তখন রাজীব গান্ধী একটা কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “দাড়িওয়ালা কিছুদিন পরে আক্ষেপ করবে সেই দিনটা নিয়ে, যেদিন আপনাকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হতে বলেছিলেন।”
রাজীব গান্ধী কেন এই কথা বলেছিলেন, তা বোঝা গিয়েছিল কয়েকদিন পরেই। নিজে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হলেও, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমদিনই তিনি অফিস থেকে সমস্ত দেবদেবীর ছবি সরিয়ে দিয়েছিলেন। ৯০-র দশকে নির্বাচন ঘিরে যে অরাজকতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। ভুয়ো ভোটার থেকে শুরু করে টাকার ব্যবহার, প্রভাব খাটিয়ে ভোট করানো, বুথ দখল করা, হিংসার মতো ঘটনা খুব সাধারণ ছিল বিহার, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পরই তিনি ১০০টিরও বেশি নির্বাচনী নীতি বিরুদ্ধ কাজের একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন, যার মধ্যে ভোটের আগে বিনামূল্যে মদ বিতরণ থেকে শুরু করে ভোটারদের ঘুষ দেওয়া, নির্বাচনী প্রচারে ধর্মের ব্যবহারের মতো বিষয়ের উল্লেখ ছিল। নির্বাচনী প্রচারে কত টাকা খরচ করা যাবে থেকে শুরু করে আদর্শ আচরণবিধি স্থির করেছিলেন তিনি। ভারতীয় নির্বাচনী ব্যবস্থায় টিএন শেষণের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল ভোটার আইডি কার্ড চালু করা।
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে টিএন শেষণের সবথেকে বড় পদক্ষেপ ছিল ১৯৯১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর লোকসভা নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। এর জন্য তিনি সরকার বা বিরোধী দলগুলির সঙ্গে শলা-পরামর্শও করেননি। বরাবরই নির্বাচন কমিশনকে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবেই পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে টিএন শেষণ ১৭ পাতার একটি নির্দেশিকা জারি করেন। সাংবিধানিক দায়িত্ব মনে করিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকার যতদিন নির্বাচন কমিশনকে স্বতন্ত্র বলে গণ্য করছে না এবং কমিশনের ক্ষমতাকে মান্যতা দিচ্ছে না, ততদিন দেশে কোনও নির্বাচন হবে না। শাসক থেকে বিরোধী, সমস্ত রাজনৈতিক দলই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও, তাতে কর্ণপাত করেননি শেষণ। তাঁর এই সিদ্ধান্তের কারণে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পদের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় এবং তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিতে হয়।
টিএন শেষণের এই সিদ্ধান্তের কারণে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনও স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু টিএন শেষণের এই সিদ্ধান্তে এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে ‘পাগলা কুকুর’ বলে সম্মোধন করেছিলেন। দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ সিংও বলেছিলেন, “কারখানার মতো গণতন্ত্রের লকআউট হয়ে গেল।”