আলিপুরদুয়ার: একটা সময় ছিল, যখন ভিড়ে ঠাসা ছিল এই অফিস ঘর। লালবাতি গাড়ির আনাগোনা লেগেই থাকত। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। দিন বদলেছে। সঙ্গে ফিকে হয়েছে চেহারাও। কথা হচ্ছে আরএসপির আলিপুরদুয়ার জেলা কার্যালয়ের। যাঁরা আগে থেকে চেনেন না, তাঁরা হয়ত আজকের দিনে বাইরে থেকে দেখে ঠাওর করতে পারবেন না এটা কোনও দলের জেলা অফিস। পার্টি অফিসটার জীর্ণ দশা হয়ে গিয়েছে। বাইরের প্লাস্টারে শ্যাওলা জমেছে। ভিতরেও প্লাস্টার ফাটতে শুরু করেছে। কিছু চেয়ার টেবিল, আলমারি আছে। সেগুলিরও অবস্থা খুব একটা ভাল বলা যায় না। দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকার ফলে যেমন হয়, তেমনই হাল।
ভিতরে লেনিন, মার্ক্সের বড় বড় ছবি রয়েছে। দলের বাকি কমরেডদের ছবিও আছে। দলের যা চেহারা, তা দেখে সেই মুখগুলিও যেন কিছুটা গুমরে গিয়েছে। বাইরে কোনও সাইনবোর্ডও নেই। সচরাচর এমন দেখা যায় না কোথাও। পাড়ার কোনও পার্টি অফিস হলে একটা অন্য বিষয়। কিন্তু এ যে জেলা অফিস! রাজ্যে আর কোথাও কোনও দলের জেলা অফিস এমন সাইনবোর্ডহীন রয়েছে কি না, বলা মুশকিল। যদিও সেই সাইনবোর্ডহীন হওয়ার পিছনে এক অন্য কাহিনী রয়েছে। সে কথায় পরে আসা যাক। একটা লাল ঝান্ডা একাকী উড়ে যাচ্ছে অফিস ঘরের সামনে। ওটা যে কোনও দলের জেলা সদর কার্যালয়, তা বোঝার একমাত্র উপায় ওই লাল ঝান্ডাই।
বামফ্রন্টের প্রধান শরিক দল সিপিএম হলেও, এককালে আলিপুরদুয়ারে দাপট দেখাত আরএসপিই। বাম জমানায় পাঁচটির মধ্যে চারটি বিধানসভা কেন্দ্রেই আরএসপির বিধায়ক ছিলেন। আলিপুরদুয়ার। কুমারগ্রাম। কালচিনি। মাদারিহাট। এই চার বিধানসভা ছিল আরএসপির দখলে। আর বাকি একটি বিধানসভা ছিল সিপিএমের। বাম জমানায় দলের সেই চাকচিক্য সময়ের সঙ্গে মলিন হতে হতে এখন একেবারে সাদা-কালো হয়ে গিয়েছে। জীর্ণ পার্টি অফিস। আরও জীর্ণ দলের অবস্থা। যে পার্টি অফিসে এককালে লোকে লোকারণ্য থাকত, সেই পার্টি অফিসেই এখন মাছি তাড়ানোর জোগাড়। লোকজনের দেখা নেই। সংগঠনও আগের থেকে দুর্বল। একেবারে আইসিইউতে ঢুকে গিয়েছে বললেও অত্যুক্তি হয় না। সারাদিনে বড়-জোড় দু’এক জনের দেখা মেলে।
এই জেলা অফিসের বাইরে সাইনবোর্ড না থাকার পিছনের কারণ অবশ্য দলের দৈন্যতা নয়। এর পিছনে রয়েছে অন্য একটি কারণ। যাঁরা আজকের দিনে জেলায় আরএসপির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, তাঁদেরও অনেকে দলে যোগ দেওয়ার দিন থেকে এই সাইনবোর্ড দেখেননি। তাঁরা শুনে আসছেন, এককালে পার্টি অফিসে সাইনবোর্ড ছিল। কিন্তু কংগ্রেস জমানায় নাকি একবার তাঁদের পার্টি অফিসে হামলা হয়েছিল। ভাঙচুর করা হয়েছিল সাইনবোর্ড। তখন থেকেই দলের নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, জেলা অফিসে আর সাইনবোর্ড লাগানো হবে না। আরএসপির আলিপুরদুয়ার শহর লোকাল কমিটির সম্পাদক সুনির্মল বিশ্বাসের কথায়, সেই থেকে আরএসপির জেলা অফিস ‘জণগণের পার্টি অফিস’ হিসেবেই রয়ে গিয়েছে।
এখন লোকজনের ভিড় কমলেও, পার্টি অফিসে রোজ নিয়ম করে আসেন কৃষ্ণ সাউ। একাই পার্টি অফিস আগলে রাখেন। কৃষ্ণ দলের সাধারণ এক কর্মী। দলের হোলটাইমার। অল্প বয়সি। তরুণ রক্ত। এককালে যেখানে এত লোকের ভিড় থাকত, আজ সেখানে এমন দুর্দশা। দেখে কিছুটা মন খারাপ হয় কৃষ্ণর। খারাপ লাগার সুর কুঁকড়ে বেরিয়ে আসে গলা থেকে। বললেন, ‘আগের মতো তো আর লোকজন আসবে না। আমাদের তো এখন কিছুই নেই এখানে।’ হাজার মন খারাপ থাকলেও ঘুরে দাঁড়ানোর আশা ছাড়ছেন না কৃষ্ণ। রাজনীতির নীতি-আদর্শকে জলাঞ্জলি না দিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়েই রোজ পার্টি অফিসে এসে বসেন। বাকি একজন, দুজন যাঁরা আসেন, তাঁদের সঙ্গে রাজনীতির চর্চা করেন।
একসময়ে আলিপুরদুয়ারের রাজনীতিতে বামফ্রন্টের প্রধান শরিক ছিল আরএসপিই। সেই সংগঠন এখন আর নেই। রাজনীতির পালাবদলের পর থেকে ভিড় কমতে শুরু করেছে। সভায় ভিড় কমেছে। মিছিলে ভিড় কমেছে। পার্টি অফিসটাতেও লোকজন তেমন আসেন না। এখন তাই সিপিএমের প্রদীপের তলায় টিম টিম করে জ্বলছে আরএসপির ধুপদানি। কোনওক্রমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই লড়ছে। এবারের পঞ্চায়েতেও হাতে গোনা কিছু আসন পেয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে ১২৫২টি আসনের মধ্যে ১৬৩টি, সমিতিতে ১৮৯টি আসনের মধ্যে ২৭টিতে প্রার্থী দিয়েছে। জেলা পরিষদেও একই হাল। ২৭টির মধ্যে মাত্র ৭টিতে ভোটে লড়ার সুযোগ পেয়েছে আরএসপি। ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু আরএসপি আবার ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে পঞ্চায়েতের ময়দানে। পারবে কি ঘুরে দাঁড়াতে? উত্তরণ কি হবে? নাকি ক্ষয়িষ্ণু থেকে আরও ক্ষয়িষ্ণু হবে?
দলের জেলা সম্পাদক সুব্রত রায়, কিংবা আরএসপির হয়ে পাঁচবার বিধায়ক হওয়া নির্মল দাসদের কাছে পঞ্চায়েত ভোটটা একটা বড় চ্যালেঞ্জের মতো। দেওয়ালে পিঠ প্রায় ঠেকেই গিয়েছে। এবার তাই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই তাঁদের। পারবেন কি তাঁরা সফল হতে? কথায় বলে, কিছু হারানোর ভয় না থাকলে, লড়াইটা আরও জোরদার করা যায়। আরএসপি কি সেই প্রবাদকে সত্যি প্রমাণ করতে পারবে?
যুব সংগঠন বলতে জেলায় প্রায় কিছুই নেই। এককালে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা গিয়ে নাম লিখিয়েছেন কেউ ঘাসফুলে, কেউ পদ্মফুলে। সে কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন দলের নেতারাই। যদিও কৃষ্ণদের মতো কেউ কেউ আছেন অবশ্য। তাঁরাই এখন দলের ভরসা। জেলা সম্পাদক সুব্রত রায়ের কথায়, দল ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। যেটুকু যা সংগঠন রয়েছে, শক্তি রয়েছে, তা নিয়েই প্রচারের নামছেন তাঁরা। নির্মলবাবুও আশাবাদী, দিন বদলাবে। বলছেন, মানুষই সমাজ বদলাবে। গ্রামে গ্রামে প্রচারে বেরিয়ে দল নতুন করে অক্সিজেন পাচ্ছে, উজ্জীবিত হচ্ছে বলেও মনে করছেন তিনি। সকলে মিলে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন ঘুরে দাঁড়াতে।