বাঁকুড়া: পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। একাধিক প্রাণহানির ঘটনাও সামনে এসেছে। পঞ্চায়েত ভোট মিটে গিয়েছে। কিন্তু পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠন ঘিরে এখনও অশান্তির ঘটনায় বিরাম পড়েনি। কিন্তু স্থানীয় ভোট ঘিরে কেন এত হিংসার ছবি বাংলা জুড়ে? এমনকি রয়েছে পঞ্চায়েতে যার জন্য এত হানাহানি ও রক্তপাতে ভিজছে গ্রামবাংলার মাটি। সেই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করল টিভি৯ বাংলা।
আজ থেকে দু-তিন দশক আগেও রাজ্যের পঞ্চায়েতগুলির ক্ষমতা ছিল সীমিত। গ্রামাঞ্চলে নলকূপ বসানো, নলকূপ এবং পানীয় জলের কুয়োগুলির রক্ষণাবেক্ষণ ও বেহাল কাঁচা রাস্তা মেরামতি করে দেওয়া ছাড়া পঞ্চায়েতের হাতে তেমন কাজ ছিল না বললেই চলে। এমনকি সে সময় পঞ্চায়েত গুলিতে অর্থবরাদ্দও ছিল অত্যন্ত কম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে থাকে পরিস্থিতি। রাজ্যের পঞ্চায়েতগুলির ক্ষমতা বাড়তে থাকে। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের রূপায়নে শেষ স্তর হয়ে ওঠে পঞ্চায়েতগুলি। এর জেরে পঞ্চায়েতগুলির ক্ষমতা এবং গুরুত্ব দুটোই উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে সরকারি সামাজিক প্রকল্পের রূপায়নের দায়িত্ব পঞ্চায়েতগুলির কাঁধে।
বর্তমানে যে সব প্রকল্প রূপায়নের দায়িত্ব রয়েছে পঞ্চায়েতের-
১) ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প
২) আনন্দধারা প্রকল্প
৩) বাংলা সড়ক যোজনা
৪) গ্রামীণ আবাস যোজনা
৫) ইন্সটিউশনাল স্ট্রেংদেনিং অফ গ্রাম পঞ্চায়েতস বা আইএসজিপি প্রকল্প
৬) কমিউনিটি হেলথকেয়ার ম্যানেজমেন্ট
৭) নির্মল বাংলা প্রকল্প
এই প্রকল্পগুলির বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বরাদ্দ অর্থ খরচের ক্ষমতা রয়েছে পঞ্চায়েতগুলির হাতে। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট এলাকায় বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, কৃষি সরঞ্জাম প্রদান, কৃষি বিমা প্রদান-সহ বিভিন্ন পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেও উপভোক্তা নির্বাচনের ক্ষমতা রয়েছে পঞ্চায়েতের। পঞ্চায়েতের ট্রেড লাইসেন্স, বাড়ির পরিকল্পনা অনুমোদনের জন্য ফি বছর অধিকাংশ পঞ্চায়েতের হাতে আসে বিপুল পরিমাণ অর্থ। যা পঞ্চায়েতগুলি নিজস্ব তহবিলের মাধ্যমে ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারে। সব মিলিয়ে রাজ্যের একেকটি পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বছরে খরচ হয় কোটি কোটি টাকা। বিরোধীদের দাবি, সেই টাকার একটা অংশ ঘুরপথে চলে যায় পঞ্চায়েতের পদাধিকারীদের পকেটে। তাছাড়া বহু প্রকল্পে উপভোক্তা নির্বাচনের ক্ষমতা পঞ্চায়েতগুলির হাতে থাকায় এলাকার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও থাকে পঞ্চায়েতের কর্মকর্তাদের হাতে। সেই অর্থ আত্মসাৎ করা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভেই পঞ্চায়েত দখলে মরিয়া কমবেশি সব দলই। আর তারই ফলশ্রুতি হিসাবে এমন অশান্তির ঘটনা ঘটছে বলে মত শাসক-বিরোধী সবপক্ষেরই। যদিও শাসক দল তৃণমূল অবশ্য এই তত্ব মানতে নারাজ। তৃণমূলের দাবি, যেখানে বিরোধীরা শক্তিশালী সেখানেই এই ধরনের অশান্তি হয়েছে। তার কারণ এই অশান্তি করে বিরোধীরা রাজ্যের বদনাম করতে চায়।
এ বিষয়ে সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য অভয় মুখোপাধ্যায় বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে বামেরা যখন পঞ্চায়েত চলত তখন বিরোধীদেরও মর্যাদা ছিল। সমস্ত মানুষকে নিয়ে সিদ্ধান্ত হত, কোথায় কী হবে। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে পঞ্চায়েতগুলিকে টাকা কামানোর জায়গা বানিয়েছে। সে জন্য যে ভাবে পারছে বোর্ড গঠনের চেষ্টা করছে। ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনই হতে দেয়নি। এ বার যে টুকু হয়েছে, তাতেও বিরোধী সদস্যদের ভয় দেখিয়ে দলবদল করানো হচ্ছে। লক্ষ্য একটাই পঞ্চায়েত থেকে টাকা লুট।” বিজেপির বাঁকুড়া সাংগঠনিক জেলা সভাপতি সুনীল রুদ্র মণ্ডল বলেছেন, “কেন্দ্রের সমস্ত প্রকল্পের রূপায়ন হয় পঞ্চায়েত স্তরে। সেই টাকা মেরে পকেট ভরানোই তৃণমূল নেতাদের উদ্দেশ্যে। সে জন্য পঞ্চায়েতে নমিনেশন থেকে ভোটগণনা অবধি অশান্তি চলেছে। টাকার মূল উৎস পঞ্চায়েত, সে গুলো হাতছাড়া করতে চায় না তৃণমূল। তাই জনগণের রায়কে অগ্রাহ্য করে পঞ্চায়েত দখল করতে মরিয়া।” এই সব অভিযোগ উড়িয়ে বাঁকুড়া জেলায় তৃণমূলের মুখপাত্র মহাপ্রসাদ সেনগুপ্ত বলেছেন, “নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই তৃণমূলের শীর্ষ স্তর থেকে পরিচ্ছন্ন নির্বাচনের কথা বলেছিল। আমরা বিরোধীদের মনোনয়ন দিতেও সাহায্য করেছি। যেখানে বিরোধীরা জিতেছে সেখানে অশান্তি করছে বিরোধীরা। কারণ রাজ্যের বদনাম করতে মরিয়া বিজেপি। অনেক জায়গায় বিরোধীরা বোর্ড গঠন করেছে। কই আমরা তো কোনও বাধা দিইনি।”