দার্জিলিং: পাহাড়ের রাজনীতি সমতলের থেকে অনেকটা আলাদা। দাবিদাওয়া, ইস্যু… সবই আলাদা। সেই মতো রাজনীতির সমীকরণও বদলায় হিমালয়ের কোলে। তবে তাই বলে এতটা! একেবারে ‘রাম-বাম’ ঘোষিত জোট। নীতি-আদর্শ বলে কি আর কিছুই থাকল না? নামে বাম, আর কাজের বেলা রাম? এবারে পাহাড়ের দ্বিস্তরীয় পঞ্চায়েতে বিজেপির শাসক বিরোধী মহাজোটের অন্যতম শরিক দল এরা। ব্যাপারটা কী!
মার্ক্সের নাম নিয়ে কী কী না হতে পারে! কমিউনিস্ট দল। বামপন্থী। দলের নামের সঙ্গেও জড়িয়ে মার্ক্স। মার্ক্সবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। প্রতীকে কাস্তে-হাতুড়ি। শ্রমিক ঐক্যের মে দিবসও পালন করে ঘটা করে। কিন্তু হাত মিলিয়েছে কট্টর দক্ষিণপন্থী বিজেপির সঙ্গে। মার্ক্স যদি আজ জীবিত থাকতেন, তাহলে না জানি এই দৃশ্য দেখে কী করতেন।
নাহ, এর সঙ্গে সুজন চক্রবর্তী, মহম্মদ সেলিমদের সিপিএমের কোনও প্রত্যক্ষ যোগ নেই। কথা হচ্ছে, কমিউনিস্ট পার্টি অব রিভলিউশনারি মার্ক্সিস্ট নিয়ে। সিপিএম বাম বামফ্রন্টের সঙ্গে আজকের দিনে এদের কোনও যোগাযোগ নেই। তবে এদের জন্ম হয়েছে সিপিএমের গর্ভেই। বঙ্গ সিপিএমের এক বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী এরা। আগে সিপিএমের সঙ্গেই ছিল। পরে আলাদা হয়ে নতুন দল গঠন করে। আর এখন পঞ্চায়েত ভোটের মুখে একেবারে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফেলেছে। ঘোষিত জোটসঙ্গী। কেন এমন অবস্থা তৈরি হল? কেন হঠাৎ এক দক্ষিণপন্থী ও এক বামপন্থী দলের জোট? নেপথ্যে কী এমন সমীকরণ রয়েছে?
কারণ খুঁজতে গেলে, অনেকটা সময় পিছিয়ে যেতে হবে। বাম জমানায়। আশি-নম্বইয়ের দশকে। আশির দশকে পাহাড় তখন উত্তাল। আলাদা রাজ্যের দাবি। পাহাড়ের প্রতিটি আনাচে কানাচে তখন পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি। সেই উত্তাল পরিস্থিতি সামাল দিতে দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ তৈরি করে দেওয়া হয়। স্বশাসিত সংস্থা। কিন্তু আলাদা রাজ্য নয়। জিএনএলএফ ও বাম সরকারের এই শান্তি চুক্তিতে মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না পাহাড়ের সিপিএম নেতাদের একাংশ। তাঁদের দাবি ছিল, আলাদা গোর্খাল্যান্ড। আর সেই দাবি নিয়েই ১৯৯৬ সালে সিপিএম থেকে আলাদা হয়ে যান বিক্ষুব্ধ নেতারা। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা প্রাক্তন রাজ্যসভা সাংসদ তামাং দাওয়া লামা ও দার্জিলিঙের প্রাক্তন সাংসদ রত্ন বাহাদুর রাইয়ের নেতৃত্বে একঝাঁক বিক্ষুব্ধ নেতারা বেরিয়ে আসেন সিপিএম থেকে। তৈরি হয় কমিউনিস্ট পার্টি অব রিভলিশনারি মার্কিস্ট বা বিপ্লবী মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি।
দল তৈরির সময় থেকেই অবস্থান স্পষ্ট সিপিআরএমের। পৃথক রাজ্যের বদলে দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ তৈরির মাধ্যমে যে শান্তিচুক্তি হয়েছিল পাহাড়ে, তা মেনে নিতে পারেনি তারা। সেই থেকে গোর্খাল্যান্ড ইস্যুকেই হাতিয়ার করেই পাহাড়ের রাজনীতিতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে বার বার পাহাড়ে সুর চড়িয়েছে। রাস্তায় নেমেছে। মিছিল করেছে। এছাড়া গোর্খাদের মধ্যে যে উপজাতিগুলি রয়েছে, তাদের কাছে টানার চেষ্টাও দেখা গিয়েছে। কয়েক বছর আগে দিল্লিতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সঙ্গেও দেখা করেছিল সিপিআরএমের প্রতিনিধি দল। ১১টি গোর্খা উপজাতিকে তফসিলি উপজাতিভুক্ত করার দাবিতে।
আগাগোড়া ইস্যু ছিল গোর্খাল্যান্ড। গোর্খাদের উন্নয়ন। রাজ্য সরকার গোর্খাদের জন্য কাজ করতে ব্যর্থ, গোর্খাদের উন্নয়নে ব্যর্থ… এই অভিযোগ তুলেই বিজেপিকে সমর্থন শুরু। শুরুটা হয়েছিল ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে। পাহাড়ের বিজেপি প্রার্থীকে সমর্থন জানিয়েছিল সিপিআরএম। সিপিআরএম এবং পাহাড়ের অন্যান্য বন্ধুদলগুলির সমর্থন নিয়ে প্রথমবার পাহাড়ের দখল নিল বিজেপি।
২০১৪ সালের ভোটে দার্জিলিঙে বিজেপি প্রার্থী হন আলুওয়ালিয়া। রত্ন বাহাদুরের সঙ্গে আলুওয়ালিয়ার পরিচয় আরও আগে থেকেই। রত্ন বাহাদুর যখন সিপিএমের সাংসদ ছিলেন, তখন থেকে সংসদীয় রাজনীতির দৌলতে পরিচয় আলুওয়ালিয়ার সঙ্গে। ব্যক্তিগত স্তরে বন্ধুত্বও বেশ ভাল ছিল। লোকসভা ভোটের আগে সিপিআরএম নেতার পার্টি অফিসে গিয়েছিলেন আলুওয়ালিয়া। রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছিল দুজনের। সেবারও বিজেপিকে সমর্থন দিয়েছিল সিপিআরএম।
অতীতের এই নির্বাচনী সম্পর্কে নতুন মাত্রা আসে রাজু বিস্তার সময়ে। ২০০৯ লোকসভা, ২০১৪ লোকসভায় বিজেপিকে সমর্থন দেওয়ার পর কিছুটা সম্পর্ক আলগা হয়েছিল। পাহাড়ে আবারও মিছিল শুরু হয়ে গিয়েছিল সিপিআরএমের। গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে কাস্তে-হাতুড়ি, লালঝান্ডার মিছিল। বাজপেয়ী আমলে যেভাবে এনডিএ সরকার ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড বা উত্তরাখণ্ড তৈরি করেছিল… সেই দেখেই সমর্থন বাড়িয়েছিল তারা। কিন্তু গোর্খাল্যান্ডের ক্ষেত্রে তেমন হয়নি। সম্ভবত সেই কারণেই অসন্তোষ। ২০১৯ সালের লোকসভার জন্য আবার তৈরি হয় নতুন সমীকরণ। অবিজেপি-অতৃণমূল পাহাড়ি দলগুলি আলোচনায় বসে। সেখানে আবার জিএনএলএফের ডাকা বৈঠকে একসঙ্গে বসে সিপিএম ও সিপিআরএম। কংগ্রেসও বসেছিল সেই বৈঠকে।
কেন্দ্র ও রাজ্যের বিরুদ্ধে জমাট বাঁধা ক্ষোভ নিয়ে পাহাড়ে অবিজেপি-অতৃণমূল দলগুলির সঙ্গে বৈঠক করলেও শেষ পর্যন্ত আবার বিজেপিতেই ভরসা। বিজেপি প্রার্থী রাজু বিস্তাকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেয় সিপিআরএম। রাজু বিস্তা ছুটে গিয়েছিলেন সিপিআরএমের অফিসে। বৈঠক হয়। আর তারপরই টুইটারে রাজু বিস্তার ব্রেকিং নিউজ়। সিপিআরএম সমর্থন জানিয়েছে বিজেপিকে। রত্নবাহাদুর রাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখের ছবিও পোস্ট করেন রাজু বিস্তা। টানা তিন বার পাহাড়ের লোকসভা আসন দখলে রেখেছে বিজেপি। আর তিনবারই সমর্থন সিপিআরএমের।
পাহাড়ের রাজনীতিতে অনেকদিনের বন্ধু বিজেপি আর সিপিআরএম। কিন্তু ২০১৯ সালে রাজু বিস্তা সাংসদ হওয়ার পর তা নতুন মাত্রা পায়। দার্জিলিঙের গোর্খাদের ১১টি উপজাতিভুক্ত মানুষদের তফসিলি উপজাতিভুক্ত করার দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। সেই নিয়ে রাজু বিস্তার সঙ্গে আলোচনাও হয়েছিল সিপিআরএম নেতৃত্বের। তারপর কৈলাস বিজয়বর্গীয়র নেতৃত্বে সিপিআরএমের এক প্রতিনিধি দল দিল্লিতে যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে। নিজেদের দাবি দাওয়া জানাতে। সিপিআরএমের প্রতিষ্ঠা দিবসেও টুইটারে শুভেচ্ছা জানাতে দেখা গিয়েছে বিজেপি সাংসদকে। আর সেই টুইটার পোস্টের ছবিতে ছিল, সেদিন ভোটের আগে সিপিআরএম অফিসের দৃশ্য।
২০২০ সালের কথা। বাংলার প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় তখন উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়েছিলেন। দার্জিলিংঙের রাজভবনে গিয়ে ধনখড়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন রত্ন বাহাদুর রাইয়ের নেতৃত্বে সিপিআরএমের প্রতিনিধি দল। সেদিন তৎকালীন রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে আর বি রাই আবারও সওয়াল করেছিলেন গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে। বলেছিলেন, পাহাড়ের সব সমস্যার একমাত্র সমাধান হল গোর্খাল্যান্ড।
একুশের বিধানসভা নির্বাচনে পাহাড়ের তিনটি আসনেই (দার্জিলিং, কালিম্পং ও কার্শিয়াং) প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এই বামপন্থী দল। প্রার্থীদের নামও ঘোষণা করে দিয়েছিল। কিন্তু তার কিছুদিন পরেই সিদ্ধান্ত বদল করে বিজেপিকে সমর্থনের কথা জানিয়ে দেয়। গোর্খাল্যান্ডের দাবি-দাওয়া নিয়ে বিজেপিকে পাহাড়ে একপ্রকার চাপে রাখার কৌশল বলেই তা মনে করেন অনেকে।
পাহাড়ে বিজেপির বন্ধুদল চলতি বছরেও ছুটে গিয়েছিল দিল্লিতে। ফেব্রুয়ারি মাসের কথা আবার মোহভঙ্গ হয়েছিল। বিজেপি যা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। সেই অভিযোগ তুলেই দিল্লির জন্তরমন্তরে ধরনায় বসেছিল সিপিআরএম নেতৃত্ব। তাদের বক্তব্য ছিল, যেহেতু তারা বিজেপির শরিক দল, তাই তাদেরও মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।
দ্বিস্তরীয় পঞ্চায়েতে আগে আবার একজোট। তৃণমূল-অনীত থাপাদের শাসক জোটের বিরুদ্ধে আবার এককাট্টা হচ্ছে বিরোধীরা। বিজেপির ছত্রছায়ায় শাসক বিরোধী মহাজোট তৈরি হয়েছে। সেখানে বিজেপির নেতৃত্বে এক ছাতার তলায় আবার এসেছে সিপিআরএম। সঙ্গে রয়েছে হামরো পার্টি, জিএনএলএফ, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার মতো দলগুলিও।
বিজেপি শাসনে ইতিপূর্বেই বেশ কিছু রাজ্যকে আলাদা করে নতুন রাজ্য গঠন করা হয়েছে। সিপিআরএমও সেই আশাতেই রয়েছে। আশা, বিজেপির হাত ধরেই গোর্খাল্যান্ড আসবে। সেই আশাতেই বার বার সমর্থন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে এক বিবৃতিতে রাজ্যের শাসক শিবিরকে একহাত নিয়ে সিপিআরএম বলেছিল, ‘যারা পাহাড়ের গণতন্ত্র, পাহাড়ের তরুণ প্রজন্মকে হত্যা করেছে, তাদের আমরা সমর্থন করতে পারি না। তাই দলের সবস্তরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে বিজেপিকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
সিপিআরএম নেতা সুনীল রাই বলছেন, ‘এখন যা পরিস্থিতি তাতে শাসক দলই পঞ্চায়েত স্তরে রাজত্ব করছে। পাহাড়ের মানুষের উন্নয়ন হচ্ছে না। যতক্ষণ না সব দলগুলি একসঙ্গে আসছে, ততক্ষণ এটা সম্ভব হবে না। তাই পঞ্চায়েতে সমাজের উন্নয়নের জন্য আমরা একসঙ্গে এসেছি।’ বিজেপির দার্জিলিং জেলা সভাপতি এলএম লামার মুখেও একই কথা। বলছেন, ‘দুর্নীতির কারণেই পাহাড়ে উন্নয়ন হচ্ছে না। তাই আমরা একসঙ্গে এসেছি সব দলগুলি।’
বিজেপির রাজ্য মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যা, পাহাড়ের সিপিআরএম, আর সমতলের সিপিএম মোটেই এক নয়। ওখানে যাঁরা বামপন্থী আছেন, তাঁরা সিপিএম থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। পরিস্থিতির তাগিদে জোট হয়েছে। পঞ্চায়েতে ময়দানে জমির রসায়ন থাকে, মানুষের ভাবাবেগ থাকে। সেটাকে নির্দিষ্ট দলীয় আবহে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।’
উত্তরবঙ্গের তাবড় সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্য আবার সিপিআরএমকে কোনও বামপন্থী দল হিসেবে ধরতেই চান না। বলছেন, ‘বিজেপির সঙ্গে যারা যায়, তাদের আর বামপন্থী কীভাবে বলব!’ সিপিআরএম যে বারবার এভাবে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, সেই কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর আবার ব্যাখ্যা, সিপিআরএম পাহাড়ের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বই রাখে না। কারণ, তারা সিপিএমের থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি হয়েছে। সেক্ষেত্রে পাহাড়ে সিপিএমই দুর্বল হয়ে গিয়েছে, তাহলে তাদের থেকে বেরিয়ে আসা একটা দল আর কতটা গুরুত্ব পেতে পারে! ফলে সিপিআরএমের সঙ্গে বিজেপির জোট আলাদা করে কোনও প্রভাব পাহড়ের রাজনীতিতে ফেলবে না বলেই মত বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর।