হুগলি: রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আলু চাষিদের অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে বিগত কিছুদিন ধরে। রাস্তায় আলু ফেলে দেওয়া হচ্ছে। চাষিরা বলছেন, তাঁরা আলুর দাম পাচ্ছেন না। সরকারের তরফে চাষিদের থেকে আলু কেনা হচ্ছে বটে, কিন্তু তাতেও লাভের সিকিভাগও দেখতে পাচ্ছেন না কৃষকরা। চাষিরা দাবি তুলছেন, সরকার আরও দাম বাড়াক আলুর। ক্ষোভে ফুঁসছেন আলুচাষিরা। সবথেকে বেশি অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে হুগলি জেলায়। কিন্তু কেন এই অসন্তোষ? কোথায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে? কতটা ক্ষতির মুখে পড়ছেন কৃষকরা? হুগলি জেলার বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে খোঁজখবর নিলেন টিভি নাইন বাংলার প্রতিনিধিরা।
এই রাজ্যে আলুর উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৯০ লক্ষ মেট্রিক টন। যার বেশির ভাগই হুগলি জেলায়। প্রায় ৩০ লক্ষ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয় হুগলিতে। তার মধ্যে এ রাজ্যে প্রায় ৫৬ লাখ মেট্রিক টন আলু খাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। বাকি এই বিপুল পরিমাণ আলু উদ্বৃত্ত । আর এখানেই সমস্যা। চাহিদার তুলনায় ফলন বেশি। আর সেই কারণে দাম উঠছে না ফলনের।
আলুর ফলন ভাল হলে, রাজ্যের চাহিদা পূরণের পর সেই আলু ভিন রাজ্যে রফতানি হত। ফলে, আলু চাষিদের ক্ষতির মুখ দেখতে হত না। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিন রাজ্যেও আলুর ফলন ভাল হচ্ছে। তাই রফতানি হচ্ছে না বাংলা থেকে। উদ্বৃত্ত আলু মাঠেই পচছে।
গতবছর আলু চাষিরা প্রতি ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি করেছিলেন ৫০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত দামে। কিন্তু এই বছর তার ধারেকাছেও নেই। এই বছর আলু বিক্রি করতে হচ্ছে খুব বেশি হলে প্রতি বস্তা ২৮০ টাকা থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে। কৃষকরা বলছেন, এক বিঘা আলু চাষ করতে গেলে প্রায় ২৫ হাজার টাকার খরচ। আর সেখানে ফলন বিক্রি করে হাতে আসছে ১০-১২ হাজার টাকা। ফলে লাভের মুখ দেখা তো দূরের কথা, ক্ষতির অঙ্ক গুনতে গুনতেই হিমশিম খাচ্ছেন কৃষকরা।
সরকারের থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, প্রতি কুইন্টাল আলু চাষিদের থেকে ৬৫০ টাকায় কেনা হবে। অর্থাৎ প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় হিসেব করলে, সেই আলুর বস্তার বিক্রয় মূল্য হয় ৩২৫ টাকা। বাইরে যেখানে আলু ২৮০-৩০০ টাকায় প্রতি বস্তা বিক্রি করতে হচ্ছে, সেখানে সরকার বেশি কিছুটা বেশি দামেই কিনছে। কিন্তু চাষিরা বলছেন, আপাতভাবে সরকারের এই দাম বেশি মনে হলেও এখানে আরও বেশি ক্ষতি হচ্ছে তাঁদের। চাষিদের বক্তব্য, সরকারি দরে আলু বিক্রি করতে হলে জমি থেকে আলু প্যাকেট জাত করে হিমঘর পৌঁছে দিতে হবে। হিমঘর পযন্ত এক বস্তা আলু প্যাকেট জাত করে পৌঁছে দিতে হলে আলু বাছাই করে ওজন করা, বস্তা এবং গাড়ি ভাড়া মিলিয়ে খরচ পরে ৫০ টাকা। সরকারের তরফে যে ৩২৫ টাকা বিক্রয় মূল্য স্থির করা হয়েছে, তা থেকে এই ৫০ টাকা বাদ দিলে হাতে আসে ২৭৫ টাকা প্রতি বস্তা। যা বর্তমান বাজারদর থেকেও প্রায় ২৫ টাকা কম।
কিছুটা লাভের আশা নিয়ে বিঘা প্রতি ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে এবারও আলু চাষ করেছেন হুগলির চাষিরা। কেউ মহাজনদের থেকে ধার-বাকি নিয়ে, কেউ নিজের সঞ্চয়ের পুঁজি থেকে খরচ করে চাষ করেছেন। কিন্তু আলুর ফলন ওঠার সময় থেকেই দাম একেবারে তলানিতে। প্রচুর টাকার লোকসানের মুখে চাষিরা। যেখানে অন্যান্য বছর কাঠা প্রতি ফলন হয় গড়ে ৫ বস্তা ফলন হত, এই বছর কাঠা প্রতি আলুর ফলন হয়েছে কোথাও তিন বস্তা, তো কোথাও সাড়ে তিন বস্তা। এদিকে বেড়েছে চাষের আনুষাঙ্গিক খরচ। এমন কঠিন অবস্থায় মহাজনদের ঋণ শোধ করার জন্য কম দামেই আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা। তাঁরা বলছেন, এতটাই দুর্দশা যে এবারে আলুর দাম না হলে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না তাঁদের কাছে। রাজ্য সরকারের কাছে চাষিদের কাতর আর্তি, আলুর সহায়ক মূল্য বাড়িয়ে অন্তত ৮০০-১০০০ টাকা করা হোক।
বৃহস্পতিবার রাজ্য বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং মুখ খুলেছেন চাষিদের সমস্যার কথা নিয়ে। গতকাল মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আলুর দাম কম হওয়ায় চাষিরা সমস্যায় পড়েছেন। আমরা ৬.৫০ টাকায় আলু কিনছি।’
রাজ্যের কৃষিজ বিপণন দফতরের মন্ত্রী বেচারাম মান্নাও এর আগে জানিয়েছেন, ১০ লক্ষ মেট্রিক টন আলু কেনা হবে ৬৫০ টাকা প্রতি কুইন্ট্যাল দরে। সব দিক বিবেচনা করে কৃষকের কী খরচ হতে পারে, তা হিসেব করে এক্সপার্ট কমিটি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
আলুর সহায়ক মূল্য বাড়ানোর দাবিতে সরকারকে খোঁচা দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভার সহ-সভাপতি ভক্তরাম পান। তাঁর বক্তব্য, সরকার যে দাম বেঁধে দিয়েছে, তাতে খরচ উঠবে না চাষিদের। তাঁর দাবি, সরকার ১০০০ টাকা কুইন্ট্যাল প্রতি দাম ধার্য্য করুক।
পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির চেয়ারম্যান লালু মুখোপাধ্যায়ও জানাচ্ছেন, আলুর কুইন্টাল পিছু দাম ৬৫০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা হলে কৃষকরা আরও বেশি উপকৃত হতেন।