Abhinandan Banerjee: বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসবের এক মহাজাগতিক আলাপের দায়িত্বে যেন মেঘ: পরিচালক অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়
Manikbabur Megh: 'মানিকবাবুর মেঘ' ('দ্য ক্লাউড অ্যান্ড দ্য ম্যান')—বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত এই ছবির পরিচালক অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় বাঙালির সবথেকে বড় উৎসবের সঙ্গে মেঘের সম্পর্কের রয়াসনকে কেন্দ্র করে।
অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়
মেঘ—আকাশপথে যার কিঞ্চিৎ ট্র্যাফিক জ্যাম, থুড়ি যার পেঁজা-পেঁজা তুলোর মতো উপস্থিতি, লক্ষ্য করে পুজোকাতুরে হয়ে ওঠা বাঙালির দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আর এই মেঘ-ই এবার পুজোর মরশুমে চিন্তার কারণ বাঙালির। কেন? আলিপুর আবহাওয়া দফতরের তরফে বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর জানানো হয়েছে, ১ অক্টোবর নাগাদ একটি ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পূর্ব-মধ্য এবং উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ওই ঘূর্ণাবর্তের, যা বর্তমানে অবস্থান করছে দক্ষিণ-চিন সাগরে (রবিবার ফিলিপিন্সে আছড়ে-পড়া সুপার টাইফুন ‘নোরু’-ই এখন হাজির হয়েছে দক্ষিণ চিন সাগরে)। ২ অক্টোবর, অর্থাৎ সপ্তমী থেকে বৃষ্টি বাড়ার সম্ভাবনা উপকূলের জেলাগুলিতে। তবে কলকাতা সহ দক্ষিণের জেলাগুলিতে ২ থেকে ৫ তারিখ পর্যন্ত মাঝারি-বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি হবে। তাহলে কি শরতের পেঁজা-পেঁজা তুলোর ‘জিয়া নস্ট্যাল’কে এবার ধূসর করে দিতে চলেছে হাওয়া-অফিসের পূর্বাভাস?
মেঘের সঙ্গে পুজোপ্রিয় বাঙালির যেমন অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, তেমনই মেঘের সঙ্গে এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক আর একজনের—মানিকবাবুর। অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘মানিকবাবুর মেঘ’ (‘দ্য ক্লাউড অ্যান্ড দ্য ম্যান’) ছবিতে গল্প আবর্তিত হয় এক ব্যক্তির সঙ্গে মেঘের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। একাধিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত ছবি ‘মানিকবাবুর মেঘ’-এর সূত্রে সম্প্রতি রাশিয়া প্যাসিফিক মেরিডিয়ান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন চন্দন সেন। এই ছবির অন্যতম প্রযোজক বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়। সহ-প্রযোজক তাঁর অর্থাৎ বৌদ্ধায়নের স্ত্রী মোনালিসা মুখোপাধ্যায়। দুর্গাপুজো এবং মেঘের সূত্র ধরে TV9 বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হয় অভিনন্দনের সঙ্গে।
প্রশ্ন: যদি ধরে নেওয়া যায়, অভিনন্দনের জীবনেও রয়েছে সেই ধরনের কোনও মেঘ, যা তাঁকে করে দেয় ‘মানিকবাবুর’ মতো, তাহলে সেই ‘মানিকবাবু’রূপী অভিনন্দন কীভাবে দেখেন পুজোর আগের এই সময়টাকে?
অভিনন্দন: মেঘ তো আর একরকম নয়। মেঘ হরেক রকম। কখনও দাবদাহের গ্রীষ্মাকাশে এক ফালি হয়ে আশার আলো, তো কখনও বর্ষার ঘন রঙের জলদ হয়ে পরিত্রাতা। কখনও হেমন্তের আকাশে বয়ে চলা মন কেমনের ধূসর পুঞ্জ, আবার কখনও শ্রাবণ শেষের রোদ ঝকমকে শরতের আকাশে উজ্জ্বল আগমনী দূত। নানা স্থিতিতে মেঘের অস্তিত্ব নানা রকম। সে অসীম। সে অধরা। সীমাহীন। তার নানা বাহার। ঠিক মন যেমন। কখনও মন খারাপ, তো কখনও মন ভাল। কখনও মন উদাস, তো কখনও মন কেমন। মেঘ ও মন—এই দুই-ই সাদৃশ্যগতভাবে কেমন যেন এক সুরে গাঁথা। উপমা-রূপকের ঊর্ধ্বে গিয়ে এরা মিলেমিশে বিলীন হয়ে গিয়েছে আমার কাছে… সেই কবে থেকে।
‘মানিকবাবুর মেঘ’-এ মানিকবাবু নিজেও মেঘের মধ্যে মন কিংবা মনের মধ্যে মেঘ খুঁজে পান। এবং তার জীবন পাল্টে যায় রাতারাতি। এই ছবির মেঘ-মানুষের সম্পর্কের সিনেম্যাটিক বা স্পিরিচুয়াল ‘Allegory’-র অন্তরে কিন্তু একটা শিশুসুলভ কৌতূহলী মন আছে। যে কৌতূহল ছাড়া কল্পনা হয় না। আর যে কল্পনা ছাড়া রোম্যান্স অসম্ভব। আর সেই রোম্যান্সের ভিতের উপরেই কিন্তু মানিকবাবু আর মেঘের সম্পর্কের উত্তরণ। আর সেই একই রোম্যান্সের ভিতের উপরেই শরতের পেঁজা মেঘদল দেখে আমাদের, বাঙালিদের ‘মনটা আহারে’ হয়ে ওঠা।
আমার কাছে শরতের মেঘ মানেই প্রকৃতির অনন্ত সময়ের নিরন্তর দূত, যা ইস্টলোক থেকে শারদীয়া বার্তা ভূলোকে বয়ে আনছে সেই কোন সুদূর সময় থেকে। বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসবের এক মহাজাগিতিক আলাপের দায়িত্বে যেন ওরা। ওরা যেন ব্রহ্মের মতো। কোনও শুরু বা শেষ নেই। না সিঙ্গুলার না প্লুরাল—স্রেফ আবহমান। ছেলেবেলা থেকেই বৃষ্টিসিক্ত রাতের আকাশকে ভোজবাজির মতো পাল্টে গিয়ে উজ্জ্বল পরিষ্কার আকাশে দুধ সাদা ভেসে বেড়ানো মেঘদলের দর্শন মানেই মায়ের আসার আর দেরি নেই। মেঘেরা সব রূপেই আমার কাছে জ্যান্ত। প্রাণময়। কিন্তু এই শরতে এসে এরা যেন শুধু প্রাণময় নয়, ঈশ্বরের দূতও বটে। যেন প্রতিটা শরতের মেঘের প্রাণকম্পন মিলিত হয়ে এমন এক অনুরণন তৈরি হচ্ছে, যা অচিরেই বয়ে আনছে ঢাকের বোল, কাঁসার ধ্বনি, উলুর টান, চণ্ডীপাঠ কিংবা সন্ধিপুজোর মন্ত্রধ্বনি। আবহমান কাল ধরে। বাংলার বুকে। বাঙালির মনে।
‘Animism’ বা ‘সর্বপ্রাণবাদ’ বলে একটা বিষয় আছে। সহজভাবে বললে এ এমন এক আধ্যাত্মিক দর্শন, যার মূল কথা হল, বিশ্বপ্রকৃতির সব কিছুরই প্রাণ আছে। ধর্মীয় নৃবিজ্ঞান মতে পৃথিবীর নানা প্রান্তের আদিবাসী গোষ্ঠীয় মানুষদের ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক ইতিহাসের সঙ্গে এর ওতপ্রোত মেলবন্ধন। সৃষ্টির জগতেও এই ভাবধারার বিকিরণ প্রকট। আমাদের রবীন্দ্রনাথ থেকে জাপানি অ্যানিমেশন-ফিল্মমেকার হায়াও মিয়াজাকি-সহ অসংখ্য কালজয়ী স্রষ্টারা প্রকৃতির আনাচে-কানাচে খুঁজে পেয়েছেন প্রাণ এবং সেই দর্শনেই গড়ে তুলেছেন তাঁদের একের পর-এক সৃষ্টি… ইত্যাদি।
‘Animism’ বিষয়ক এসব তত্ত্বকথা কিংবা বিশ্লেষণ আমি কিন্তু জেনেছি অনেক পরে। এই গতবছর কি আগের বছর। কিন্তু এই তত্ত্বকথার মূল যে সুর, সেই দর্শনপথকে নিজেই আবিষ্কার করে বেড়ে উঠেছি সেই কোন ছেলেবেলা থেকে। কেউ তো এভাবে ভাবতে বা perceive করতে আমাকে শিখিয়ে দেয়নি! কেউ মেঘদের প্রাণপিণ্ডরূপে আলাপ করিয়ে দেয়নি! তবে কীভাবে অন্যান্য প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের মতোই মেঘেরাও জীবন্ত হয়ে উঠল আমার চেতনে? বা বৃহত্তর ভাবে দেখলে, আমাদের সকলের মননে?
আমার নিজস্ব বিশ্বাস এই ‘Animism’ বা ‘সর্বপ্রাণবাদ’ কোনও থিয়োরি বা দর্শনতত্ত্বের ঊর্ধ্বে গিয়ে সব প্রাণীকুলের কাছেই ছিল শাশ্বত সত্য—সেই আদিম যুগ থেকেই। যখন প্রকৃতির সবকিছুর মধ্যেই প্রাণের স্বাদ পেতাম আমরা। এরপর আধুনিকতার বিবর্তনের আড়ালে ধীরে-ধীরে আমরা সরে এসেছি প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তার থেকে। প্রকৃতিকে জড় ভেবে দূরে সরিয়ে ডুব দিয়েছি প্রযুক্তিসমুদ্রে। তবু যেটুকু আমাদের জেনেটিক কোডিং-এ কিংবা মনের অভ্যন্তরে গাঁথা প্রকৃতির নাড়ির টান থেকে গেছে, সেই টান থেকেই বোধহয় শরতের মেঘেদের সুরে-সুরে আগমনীবার্তা আজও পৌঁছে যায় মনে। দূর দিগন্তে কাশের ঢেউ আর মেঘের ঢেউ যেখানে মিলেমিশে এক হয়ে যায়, সেই দিগন্ত পথ বেয়ে ঢাকিরা দল বেঁধে হেঁটে যায় কোনও বারোয়ারি তলার মাঠের উদ্দেশে। মা আসে এক আকাশ মেঘবাহনে চেপে, বাংলার বুকে…
প্রশ্ন: ‘মানিকবাবু’রূপী অভিনন্দনকে এই পুজোয় ‘মেঘপিওন’ হতে বললে কেমন হবে তাঁর ষষ্ঠী থেকে দশমীর দিনগুলো?
অভিনন্দন: মেঘপিওনের তো পুজোর ছুটি। ফলে সে বরং ওই ক’টা দিন শান্তিতে বাড়িতে কাটাবে বেশ। আমার পুজো মানে, ভিড়ে নয় মোটেই। আমি উৎসবে বিশ্বাস করি, কোলাহলে নয়। ফলে মেঘপিওনের পুজোর দিনগুলো একেবারেই ঘরোয়া সুরে পড়াশুনো, খাওয়াদাওয়া ও অন্যান্য নিপাট ঘরোয়া যাপনে বাঁধা।
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ