TV9 Explained: অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কী? কেন এই বিধি প্রণয়ন নিয়ে এত বিতর্ক?

Uniform Civil code: সম্প্রতি, বিজেপি কর্মীদের এক সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। সুপ্রিম কোর্টও বারংবার অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের কথা বলেছে।

TV9 Explained: অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কী? কেন এই বিধি প্রণয়ন নিয়ে এত বিতর্ক?
প্রতীকী ছবিImage Credit source: TV9 Bangla
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jun 29, 2023 | 10:23 PM

নয়া দিল্লি: নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড নিয়ে। সম্প্রতি, বিজেপি কর্মীদের এক সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। এই বিষয়ে আলোচনা চেয়েছেন। গত সপ্তাহে, গোয়ার এক সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলার শুনানির সময়, সুপ্রিম কোর্টও গোয়াকে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির এক ‘উজ্জ্বল উদাহরণ’ হিসাবে বর্ণনা করেছে। শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণ, সংবিধান প্রতিষ্ঠাতারা ভারতের জন্য একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর কথা বলেছিলেন। কিন্তু তা প্রণয়নের কোনও চেষ্টাই করা হয়নি। আসুন জেনে নেওয়া যাক, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কী এবং কেন এই বিধি প্রণয়ন নিয়ে এত বিতর্ক।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কী?

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড দেশের সকল সম্প্রদায়ের জন্য এক ও অভিন্ন আইনের কথা বলে। বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, দত্তক ইত্যাদির মতো ব্যক্তিগত বিষয়ের ক্ষেত্রে সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য একটিই আইন থাকবে। সংবিধানের ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে, ভারতব্যাপী নাগরিকদের জন্য একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তৈরির চেষ্টা করবে রাষ্ট্র। তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্যান্য নির্দেশমূলক নীতিগুলির তুলনায় অনুচ্ছেদ ৪৪-এর নির্দেশ অনেকটাই দুর্বল।

মৌলিক অধিকার না নির্দেশমূলক নীতি – কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

সমস্যা হল, এই নির্দেশমূলক নীতি সরাসরি সংবিধানে দেওয়া মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীতে যে অনুচ্ছেদ ৩১গ যোগ করা হয়েছিল, তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যদি কোনও নির্দেশমূলক নীতি বাস্তবায়নের জন্য কোনও আইন তৈরি করা হয়, তবে অনুচ্ছেদ ১৪ এবং ১৯-এর অধীনে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন হওয়ার কারণ দেখিয়ে সেই আইনকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। ১৯৮০ সালে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, মৌলিক অধিকার এবং নির্দেশমূলক নীতির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে। কোনও একটিকে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য দিলেই সংবিধানের সম্প্রীতি নষ্ট হতে পারে।

ভারতে কি ইতিমধ্যেই ব্যক্তিগত বিষয়ে অভিন্ন বিধি নেই?

ভারতীয় চুক্তি আইন, দেওয়ানী কার্যবিধি, পণ্য বিক্রয় আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, অংশীদারি আইন ইত্যাদির মতো আইনের মাধ্যমে অধিকাংশ নাগরিক বিষয়েই একটি অভিন্ন বিধি রয়েছে ভারতে। তবে বহু রাজ্য এই সকল আইনে বিভিন্ন সংশোধনী এনেছে। তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই আইনগুলির বৈচিত্র্যও রয়েছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়ণের ইচ্ছা থাকলে সংবিধান প্রণেতারা এই বিষয়টিকে ইউনিয়ন লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যক্তিগত আইনের ক্ষেত্রে সংসদকে একচেটিয়া অধিকার দিতেন। কিন্তু ‘ব্যক্তিগত আইন’ উল্লেখ করা হয়েছে কনকারেন্ট লিস্ট বা সমসাময়িক তালিকায়। গত বছর, আইন কমিশন জানিয়েছিল, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বাস্তবসম্মত নয় এবং এই আইন প্রণয়ন কাম্যও নয়।

কোন নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়েরও কি একটিই আইন আছে?

হিন্দু সম্প্রদায়ের সকলে এক আইনের আওতায় নেই। সমস্ত মুসলমান বা সমস্ত খ্রিস্টানও নয়। ভারতে শুধুমাত্র ব্রিটিশ আইনের ঐতিহ্যই নয়, কিছু কিছু অংশে পর্তুগিজ এবং ফরাসি আইনের ঐতিহ্যও জারি আছে। জম্মু ও কাশ্মীরে ২০১৯ সালের ৫ অগস্ট পর্যন্ত স্থানীয় হিন্দু আইনের বিধিগুলি, কেন্দ্রীয় আইনের থেকে আলাদা ছিল। কয়েক বছর আগে জম্মু ও কাশ্মীরে ১৯৩৭ সালের শরীয়া আইন বলবৎ করা হয়েছিল, কিন্তু এখন তা বাতিল করা হয়েছে। ফলে, কাশ্মীরের মুসলমানরা একটি প্রথাগত আইনের আওতায় আছেন। এই আইন কিন্তু অনেকাংশেই দেশের মুসলিম পার্সোনাল ল-এর থেকে আলাদা। প্রকৃতপক্ষে, হিন্দুদের জন্য যে আইন আছে, তার সঙ্গে মিল রয়েছে কাশ্মীরি মুসলিমদের আইনের। এমনকি মুসলমানদের বিবাহের আইনও স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন। এছাড়া, উত্তর-পূর্বে ভারতে ২০০-রও বেশি উপজাতি রয়েছে। তাঁদের নিজস্ব প্রথাগত আইন রয়েছে। নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মিজোরামের মতো রাজ্যে এই আইনগুলিকে রক্ষা করেছে খোদ সংবিধান।

ধর্মের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কী সম্পর্ক?

সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে ধর্মের মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৬-এর খ-তে বলা হয়েছে, প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বা তার কোন শাখা তাদের ধর্মের নিজস্ব বিষয়গুলি পরিচালনা করবে। আর অনুচ্ছেদ ২৯-এ স্বতন্ত্র সংস্কৃতি সংরক্ষণের অধিকার দেওয়া হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৫-এ বর্ণিত অধিকার কিন্তু জনশৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য, নৈতিকতার প্রশ্নে মৌলিক অধিকার বলে নাও ধরা যেতে পারে। কিন্তু, অনুচ্ছেদ ২৬-এ দেওয়া অধিকার কিন্তু অন্যান্য মৌলিক অধিকারের অধীন নয়। অর্থাৎ, কোনওভাবেই এখআনে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। গণপরিষদে মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি রাখা হবে কি হবে না, এই নিয়ে সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। ভোটের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়। ধর্মের স্বাধীনতার তুলনায়, অভিন্ন দেওয়ানী বিধি কম গুরুত্বপূর্ণ বলে উঠে এসেছিল ভোটভুটিতে। ৫ জন এই মতের পক্ষে ছিলন, ৪ জন বিপক্ষে।

গণপরিষদের মুসলিম সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল?

কিছু সদস্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। অনুচ্ছেদ ৪৪ থেকে, মুসলিম ব্যক্তিগত আইনকে বার করার জন্য তিনবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন মহম্মদ ইসমাইল। কিন্তু, তিনবারই ব্যর্থ হন। তিনি বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে মানুষের ব্যক্তিগত আইনে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় দেশে অভিন্ন ব্যক্তিগত আইন কখনও জারি করা যায় কিনা, তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন হুসেইন ইমাম। বিআর আম্বেদকর বলেছিলেন, “বিধানগুলিকে সরকার যেন এমনভাবে ব্যবহার না করে, যাতে মুসলমানরা বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়।” আল্লাদি কৃষ্ণস্বামী ছিলেন অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে। তবে, তিনিও মত স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, কোনও সম্প্রদায়ের তীব্র বিরোধিতা উপেক্ষা করে অভিন্ন দেওয়ানী বিধি প্রণয়ন করা, মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

হিন্দুরা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিতর্কে কী বলেছিল?

হিন্দু সকলের জন্য একটি অভিন্ন বিধি জারির বিরোধিতা করেছিলেন সর্দার প্যাটেল, পট্টাভি সীতারামাইয়া, এম এ আয়ঙ্গার, এমএম মালব্য এবং কৈলাশ নাথ কাটজুদের মতো নেতারা। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে যখন হিন্দু বিধি বিল নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। ২৮ জন বক্তার মধ্যে ২৩ জনই এর বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৫১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ বিলটিকে সংসদে ফিরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয় বিআর আম্বেদকরকে। জওহরলাল নেহেরু বিধিটিকে তিনটি পৃথক আইনে ভেঙে দিতে সম্মত হয়েছিলেন এবং বেশ কয়েকটি বিধান শিথিল করেছিলেন।