Buddhadeb Bhattacharya’s Birthday : বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, আশিতে পা দিয়েও বামেদের কাছে আজও ‘উত্তম’ বুদ্ধ
Buddhadeb Bhattacharya's Birthday : বিগত কয়েক মাস ধরেই শরীরটা ভাল নেই তাঁর। এখনও রয়েছে চোখ আর শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা।
কলকাতা : দেখতেন রাজ্যজুড়ে শিল্পায়নের স্বপ্ন। দিতে চেয়েছিলেন বাস্তবের রূপ। স্বপ্ন আর বাস্তবের সেই যাত্রপথেই উঠেছিল আন্দোলনের হিন্দোল। বদলে গিয়েছিল সরকার। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম বিতর্কের আবহেই, পরিবর্তনের হাওয়ায় ২০১১ তাঁর মাথা থেকে রাজার মুকুট উঠেছিল তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (CM Mamata Banerjee) মাথায়। তবে তাঁর অদম্য জেদকে পাথেয় করে আজও ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্ন দেখেন বহু সিপিএম সমর্থকই। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবির সেই মুকুটহীন বাম সম্রাট বুদ্ধদেব ভট্টচার্য (Buddhadeb Bhattacharya’s Birthday) এদিন পা দিলেন ৮০ বছরে। বিগত কয়েক মাস ধরেই শরীরটা ভাল নেই তাঁর। এদিন তাঁর জন্মদিনে বাড়িতে দেখা করতে যান বামেদের বরিষ্ঠ নেতা। ফেসবুক পোস্টে শুভেচ্ছাবার্তাও জানান সিপিএমের (CPIM) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তবে বুদ্ধবাবু শরীর আগের তুলনায় কিছুটা ভাল। স্থিতিশীল রয়েছেন তিনি। জানা যাচ্ছে এমনটা। তবে চোখ আর শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা রয়েছে গিয়েছে।
বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অনিল বিশ্বাস, শ্যামল চক্রবর্তী, সুভাষ চক্রবর্তী। এই পাঁচজন ছিলেন যাঁদের প্রমোদ দাশগুপ্ত একেবারে নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন। বলা হত প্রমোদ দাশগুপ্তের পাঁচ আঙুল। বুদ্ধবাবু কোনওদিনই ছাত্র রাজনীতিতে ছিলেন না। বিমান, অনিল, শ্যামল, সুভাষ… এরা চারজনই ছাত্র ফেডারেশন থেকে উঠে আসা। লড়াই করে উঠে আসা। পুলিশের লাঠি খেয়েছেন। জেলে গিয়েছেন। বুদ্ধবাবুকে এসব ঝক্কি কোনওদিন সেভাবে পোহাতে হয়নি। কিন্তু তারপরও বাংলার বামপন্থী রাজনীতির একটি যুগ তিনি। কলেজপাড়ায় সাহিত্যচর্চা করে ঘুরে বেড়ানো ছেলেটা কীভাবে ব্র্যান্ড-বুদ্ধ হয়ে উঠলেন? সালটা ১৯৪৪। পয়লা মার্চ। সেদিন কেই বা ভেবেছিল সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া এই ফুটফুটে ফর্সা ছেলেটা একদিন বাংলার রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়াবেন।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো। সাহিত্যচর্চার বিষয়টা জন্ম থেকেই পাওয়া। পড়াশোনা প্রথমে শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়ে। তারপর প্রেসিডেন্সিতে। বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা। রাজনীতি থেকে বহু ক্রোশ দূরে। কাকার মতোই সাহিত্যচর্চা নিয়ে থাকতে পছন্দ করেন।
নাট্যকার হতে চাইতেন। প্রেসিডেন্সির উল্টোদিকেই কফি হাউজ়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে সময় কাটাতেন। আড্ডা মারতেন। হাতে থাকত গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মারকুইজ়ের বই। কলোম্বিয়ান লেখক। তরুণ বুদ্ধদেবের জীবনে ভীষণভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল মারকুইজ়ের লেখা। শেক্সপিয়ার নিয়েও চর্চা ছিল। বুদ্ধদেব যে যথেষ্টই খুঁতখুঁতে, তা তখন থেকেই বোঝা যেত। নিজের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ে বরাবরই খুব স্পষ্ট। বুদ্ধদেব থেকে পরে যুব নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তারও পরে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর বিভিন্ন সাফল্য-ব্যর্থতা কিন্তু অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করেছিল তাঁর এই পছন্দ-অপছন্দগুলি।
অনুপ্রেরণা যখন কাকা সুকান্ত
ছাত্র জীবনে রাজনীতি থেকে বহু দূরে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু কাকার থেকে পারিবারিক সূত্রে পাওয়া বামপন্থী ভাবনাটা রয়েই গিয়েছিল। বাড়ির পরিমণ্ডলটাও ছিল। রক্ষণশীল। পড়াশোনার পরিবেশ ছিল। সেইসময় ছাত্র ফেডারেশনের প্রথম সারির যে নেতারা ছিলেন, তাঁরা বিভিন্নভাবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে দলে টানার চেষ্টা করতেন। এমনকি বাড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন, বুদ্ধদেবকে দলে আনার জন্য। কিন্তু রাজনীতিতে নামার কোনও আগ্রহ তাঁর কোনওদিনই সেভাবে ছিল না। বাড়ি থেকেও বলে দেওয়া হয়েছিল, ও এখন পড়াশোনা করছে। রাজনীতিতে যাবে না।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথাবার্তা, মেলামেশা সবসময়ই একটু স্বতন্ত্র। চোখে পড়ার মতো ব্যক্তিত্ব। স্মার্ট। ভদ্র। খুব একটা গোলমালে জড়ান না। কিছুটা রোমান্টিক গোছের পড়াশোনা করা ছেলে। এভাবেই কলেজ পাড়ায় তাঁর উঠে আসা। এদিকে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে তখন সর্বেসর্বা প্রমোদ দাশগুপ্ত। অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিপিএম নেতা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, দল আরও বড় হতে চলেছে। দলকে চালিয়ে যাওয়ার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরি করতে হবে। সেটা তিনি পাচ্ছিলেন না। তিনি এমন কয়েকজনকে খুঁজছিলেন, যাঁদের বয়স হবে বছর তিরিশের আশপাশে। যাঁরা পরবর্তীতে দলের হাল ধরবেন। যাঁদের তিনি নিজের হাতে করে তৈরি করবেন।
তখন এসএফআই ছিল। কিন্তু যুব ফেডারেশন তখনও হয়নি। বা হলেও সেভাবে সক্রিয় নয়। সেই সময় এসএফআই থেকে আস্তে আস্তে বিমান বসুর নাম উঠে আসতে শুরু করে। উঠে আসে অনিল বিশ্বাসের নাম। উদ্বাস্তু। মতুয়া। আর একজন সেইসময় বেশ ডাকাবুকো ছিলেন। শ্যামল চক্রবর্তী। যাঁকে পরে পরিবহনমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছে বঙ্গবাসী। আরও একজন ছিলেন। বাঙাল ছেলে। বস্তি এলাকা থেকে উঠে আসা। সুভাষ চক্রবর্তী। দমদম মতিঝিল কলেজের দাপুটে ছাত্রনেতা। যাঁর লোক জোগাড় করার ভাল ক্ষমতা ছিল। চারজনকেই তুলে নিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। নিজের মতো করে তৈরি করার জন্য। কিন্তু তারপরেও কোথাও একটা খামতি থেকে যাচ্ছিল। যেন কিছু একটা বাদ পড়ে যাচ্ছে। যেন আরও কয়েকজনকে দরকার। অন্তত আরও একজন।
খোঁজ চলছে। পঞ্চম সেই নতুন মুখ কে হবে। ঠিক এই সময়েই প্রমোদবাবুর ঘনিষ্ঠরা বুদ্ধদেবের নাম পাড়েন। প্রমোদবাবুও দেখা করতে চান। ডাক পড়ল বুদ্ধদেবের। গেলেন। সেখানে বুদ্ধদেবের কথাবার্তার মধ্যে একটা বলিষ্ঠ ভাব, একটা সততা চোখে পড়েছিল প্রমোদবাবুর। সুন্দর দেখতে ফর্সা ছেলেটাকে বেশ ভাল লেগে যায় তাঁর। বুদ্ধদেবের সাদার উপর একটু বেশি ঝোঁক ছিল। সাদা পাঞ্জাবি। সাদা ধুতি। এই আপাত সাদা-প্রিয় ছেলেটারও শ্যামবর্ণ প্রমোদবাবুকে বেশ মনে ধরে যায়। শিষ্য হয়ে গেলেন প্রমোদবাবুর।
সেইসময় বলা হত প্রমোদ দাশগুপ্তের পাঁচ আঙুল। বিমান। অনিল। শ্যামল। সুভাষ। আর বুদ্ধ। তিনি এই পাঁচ জনকে বেছে নিলেন, যাঁরা হবেন দলের পরবর্তী প্রজন্মের মুখ। পাঁচজনকে ছড়িয়ে দিলেন গোটা বাংলায়। কিন্তু পাঁচ জনের মধ্যে দলটাকে কে দেখবেন ? কে একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন ? বাকিদের থেকে বিমান বয়সে একটু বড়। সিনিয়র। পরিশ্রমী। ছোটাছুটি করতে পারেন। কিন্তু ওই বেঁটে, ছোটখাটো ছেলেটাই হচ্ছে আসল। অনিল বিশ্বাস। প্রমোদ দাশগুপ্তর যেমনটা ভেবেছিলেন, অনিল পার্টি দেখবেন। কিন্তু তারপরও কোথাও একটা খামতি থেকে যাচ্ছিল।
‘উত্তম’ বুদ্ধই ছিলেন প্রমোদের প্রথম পছন্দ
প্রমোদবাবু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, বাঙালিরা একটু দেখতে সুন্দর, নায়কোচিত, যাঁর পরিবারের নামডাক কিছুটা আছে, একটু ব্রাহ্মণ পদবি, এমন কাউকে বেশি পছন্দ করবেন। সেক্ষেত্রে বিশ্বাস পদবিকে যদি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া হয়, তাহলে তা কতটা কার্যকর হতে পারে, সেটা নিয়ে একটা দ্বিধা ছিল তাঁর মনে। সেক্ষেত্রে এই পাঁচ আঙুলের মধ্যে সবক’টিতে পাশ করছিলেন একমাত্র বুদ্ধদেব। উত্তমকুমার গোছের।
দূরদর্শিতা। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে প্রমোদবাবু ভেবে রেখেছিলেন ভবিষ্যতে যখন তিনি থাকবেন না, বা জ্যোতি বসু থাকবেন না, তখন পার্টি চালাবেন অনিল বিশ্বাস। আর সরকার চালাবেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পাঁচ জনকে সেইভাবেই তৈরি করেছিলেন তিনি। গোটা বাংলা ছেড়ে দিয়েছিলেন বিমানের উপর। সংগঠন করার জন্য।
বিমান বসু ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা। অনিল বিশ্বাস, সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তীও তাই। তবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেই অর্থে কোনওদিন ছাত্র ফেডারেশন করেননি। কিন্তু পাঁচ জনকেই সমান চোখে দেখতেন প্রমোদবাবু। বুদ্ধদেবকে রাজ্য সভাপতি করলেন যুব ফেডারেশনের। যুব ফেডারেশনের নাম প্রথমবার সক্রিয় হয়ে উঠে আসে তারপরেই।
বিমানদের কিন্তু অনেকটা লড়াই করে এই জায়গায় উঠে আসতে হয়েছে। পুলিশের লাঠি খেয়েছেন বিমান। অনিল, শ্যামল, সুভাষও খেয়েছেন। জেলেও গিয়েছেন। কিন্তু বুদ্ধবাবুকে সেভাবে ঝক্কি পোহাতে হয়নি। সংস্কৃতিমনস্ক। মারকুইজ় পড়েন। শেক্সপিয়র পড়েন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো।
বুদ্ধদেব বরাবরই সংস্কৃতিমনস্ক। গল্পের বই পড়েন। নাটক পড়েন। সুবক্তা। গুছিয়ে বলার ক্ষমতা ছিল। আরও যে জিনিসটা কাজ করেছিল, তা হল বুদ্ধদেবের শারীরিক গঠন। একটা সৌম্যদর্শন ভাব। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এটাও বুদ্ধদেবকে বাকি চারজনের থেকে এগিয়ে রেখেছিল। প্রমোদবাবু বুঝেছিলেন, সকলে কমিউনিস্ট নন। দলের বাইরেও একটা বড় অংশের মানুষ আছেন, যাঁরা কমিউনিস্ট নন। তাঁদের কাছে দলের প্রতিচ্ছবি কিন্তু বিমান, বুদ্ধ, শ্যামল বা সুভাষ নন। এখানে কিন্তু দলকে উপস্থাপনা করতে গেলে যাঁর মুখটা প্রমোদবাবুর সবার আগে মাথায় এসেছিল তিনি বুদ্ধদেব। সবার কাছে সমান ভাবে আপন। মিশতে পারেন। ইংরেজিতে খুব একটা সাবলীল নন। তবে বাংলাটা ভাল বলেন। কবিতা আবৃতি করতে পারেন ভাল। এগুলি কমিউনিস্ট পার্টিতে বুদ্ধদেব আসার আগে খুব একটা চল ছিল না। এখান থেকেই শুরু হয়ে গেল বঙ্গ রাজনীতিতে বুদ্ধ-যুগ। একলাফে একটা জায়গির পেয়ে গেলেন বাংলার রাজনীতির আঙিনায়। বাকিটা ইতিহাস …