Abhishek Banerjee: অভিষেকের ‘নতুন তৃণমূল’ কি মমতার ‘উন্নততর তৃণমূলের’ নয়া সংস্করণ?
Abhishek Banerjee: ‘উন্নততর তৃণমূলের’ স্বপ্ন দেখিয়ে একুশের নির্বাচনে বিপুল আসন পেয়ে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু, ‘উন্নততর তৃণমূলের’ বার্তা তাঁর ফিকে হয়নি।
দক্ষিণ কলকাতার আনাচ-কানাচে তৃণমূল পোস্টারে ছয়লাপ। সেই পোস্টারে না আছে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। না আছে তাঁর ‘অনুপ্রেরণার’ কথা। পোস্টারের কেন্দ্রবিন্দু এক বা অদ্বিতীয় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি লাগোয়া ঢাউস পোস্টারে অভিষেকের ছবির সঙ্গে লেখা, ‘মানুষ যে ভাবে চায়, সেইভাবে তৈরি হচ্ছে তৃণমূল।’ আর জ্বলজ্বল করছে যে শব্দবন্ধটি, তা হল ‘নতুন তৃণমূল’। দক্ষিণ কলকাতা জুড়ে এই পোস্টার নিয়ে স্বভাবতই চরমে উঠেছে রাজনৈতিক তর্জা। এই ‘নতুন তৃণমূল’ কী? তাহলে কি অভিষেকের হাত ধরে এবার নতুন তৃণমূল আসতে চলেছে? মমতার ব্যাটন কি আনুষ্ঠানিকভাবে অভিষেকের হাতেই চলে আসবে? পুরনোরা কি ব্রাত্য হয়ে পড়বেন? না কি পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে ‘দুর্নীতি মুক্ত’ দল তৈরির চেষ্টা মাত্র? এই সব প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক মহলে।
কয়েক দিন আগে খোদ তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ছয় মাসের মধ্যে নতুন তৃণমূল নিয়ে আসবেন তিনি। সাধারণ মানুষ যে তৃণমূল দেখতে চান, তেমনই তৃণমূল তুলে ধরা হবে। তবে, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ‘নতুন তৃণমূলের’ বার্তা এই প্রথম নয়। এর আগেও একাধিকবার ‘উন্নততর’ তৃণমূলের বার্তা দিয়েছিলেন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০১৯ সালে ‘একুশে জুলাইয়ের’ মঞ্চ থেকে ‘উন্নততর তৃণমূল’ গড়ার ডাক দিয়েছিলেন মমতা। সে দিন তিনি বলেছিলেন, “ঘরে বসে রাজনীতি হয় না। গরিব মানুষের পাশে থাকুন। উন্নততর চরিত্র গ্রহণ করুন। আমাদের উন্নততর তৃণমূল গড়তে হবে।”
কেন সে দিন ‘উন্নততর তৃণমূল’ গড়ার ডাক দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ২০১৯ সালে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত মমতার কাছে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন পেয়ে গেরুয়া শিবিরের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। তার পর পরই ‘একুশে জুলাই’। একুশের বিধানসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে শুধুমাত্র বিজেপিকে রুখতেই সে দিন ‘উন্নততর তৃণমূল’ গড়ার ডাক দিয়েছিলেন মমতা। তাঁর বার্তা ছিল, “ছাত্ররা সাথ দিন। মা বোনেরা সাথ দিন। সংখ্যালঘুদের বলছি বিশ্বাস রাখুন। আস্থা রাখুন। হিন্দুদের বলছি, বিশ্বাস রাখুন। আস্থা রাখুন।”
২০২১ সালের গোড়ার দিকে। নির্বাচনের ঢাকে সদ্য কাঠি পড়েছে। একের পর এক নেতা-বিধায়ক তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। অন্যদিকে, কয়লা পাচার তদন্তে অভিষেক-সহ একাধিক তৃণমূল ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির উপর চাপ বাড়াচ্ছে সিবিআই। সে সময় ফের ‘উন্নততর তৃণমূলের’ বার্তা দিতে শোনা যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কসবায় গীতাঞ্জলি স্টেডিয়ামে দলের তফসিলি ও অন্যান্য অনগ্রসর সংগঠনের বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “তৃণমূলের বিকল্প নেই। তৃণমূলের বিকল্প, উন্নততর তৃণমূল।” এই বার্তার ঝাঁঝ জোরালো হয়, নির্বাচনের তারিখ যত কাছে আসতে থাকে। মার্চের শেষে সাগরে গিয়ে মমতা বলেন, “এই আট বছরে যা কাজ করেছি, আগামী পাঁচ বছরে তার চেয়ে বেশি কাজ করব। উন্নত থেকে উন্নততর তৃণমূল গড়ব।”
‘উন্নততর তৃণমূলের’ স্বপ্ন দেখিয়ে একুশের নির্বাচনে বিপুল আসন পেয়ে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু, ‘উন্নততর তৃণমূলের’ বার্তা তাঁর ফিকে হয়নি। একুশের নির্বাচনের পর আরও বৃহত্তর স্বার্থে ফের ‘উন্নততর তৃণমূল’ গড়ার ডাক দিলেন মমতা। সেই বছর ‘একুশে জুলাই’ ভার্চুয়াল মঞ্চ থেকে এমনই বার্তা পৌঁছে দিলেন তিনি। তাঁর এই ‘উন্নততর তৃণমূল’ জাতীয় স্তরে বিজেপির সঙ্গে লড়াই করবে বলে জানান মমতা। এই ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেসের পি চিদম্বরম, দিগ্বিজয় সিং, এনসিপি সুপ্রিমো শরদ পাওয়ার, সমাজবাদী পার্টির নেত্রী জয়া বচ্চন, এনসিপি নেতা প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদী, অকালি নেতা বলবিন্দ সিং ভাণ্ডারী-সহ একাধিক বিরোধী দলের নেতা। তাঁদের সমানে মমতার বার্তা ছিল, “উন্নততর তৃণমূল গড়তে হবে, তবেই উন্নততর দেশ গড়তে পারব।”
জ্যোতি থেকে বুদ্ধে যখন বাম সরকার হস্তান্তর হল, সে সময়ও ‘উন্নততর বামফ্রন্টের’ ডাক শোনা গিয়েছিল। দু’দশকের বেশি সময় ধরে চলা বাম জমানার জনপ্রিয়তা থিতিয়ে যাওয়ায় ২০০১ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ‘উন্নততর বামফ্রন্টের’ বার্তা দিয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল জনপ্রিয়তাকে রুখতেই ছিল ‘উন্নততর বামফ্রন্টের’ স্লোগান। এরপরও দশ বছর বামদুর্গ অক্ষুণ্ণ ছিল। এখন সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। তারপর চব্বিশে লোকসভা। নিয়োগ-গরুপাচার-কয়লা পাচার দুর্নীতির অভিযোগে নাজেহাল তৃণমূল। কোণঠাসা আরও পার্থ-অনুব্রত গ্রেফতার হওয়ায়। দলের একাংশ মনে করছেন, তৃণমূলের ভাবমূর্তি নিয়ে নেতিবাচক ন্যারেটিভ তৈরি হচ্ছে জনমানসে। এছাড়াও, দলের অন্দরে মাঝে-মধ্যে প্রকট হচ্ছে নব্য-আদি তৃণমূলের সংঘাত। এই আবহে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নতুন তৃণমূলের’ ডাক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের প্রশ্ন, ‘নতুন তৃণমূল’ কি দলের আগাপাশতলা ‘শুদ্ধিকরণ’, নাকি ‘উন্নততর তৃণমূলের’ মতো শুধুমাত্র নির্বাচনকে মাথায় রেখে রাজনৈতিক বার্তা? উত্তর পেতে হাতে এখনও ছয় মাস।