Mahatma Gandhi: দেশ স্বাধীনের সময় কলকাতাতে গান্ধীজি, হিংসার আগুন নেভাতে ঘুরলেন বেলেঘাটা থেকে ধর্মতলা
Mahatma Gandhi: সোমবার গান্ধীজির পদযাত্রা শুরু হয় চিৎপুর রেলওয়ে ইয়ার্ড অঞ্চল দিয়ে। এই এলাকায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায় পাশাপাশি বসবাস করে আসছে বহুদিন ধরেই। এই দুই সম্প্রদায়ের এলাকা ঘুরে দেখেন গান্ধীজি।
অশান্ত কলকাতা। রোজই লাশ পড়ছে মহানগরের অলিগলিতে। ১৫ অগস্ট যত কাছে আসছে, সাম্প্রদায়িক অশান্তির অতলে যেন তলিয়ে যাচ্ছে কলকাতা। ঠিক সেই সময়ই হাজির মহাত্মা গান্ধী। সাম্প্রদায়িক হিংসা বিধ্বস্ত নোয়াখালি যাওয়ার আগে দু’দিন কলকাতায় থাকবেন বলে মনস্থির করেছিলেন গান্ধীজি। কিন্তু এখানে এসে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে মর্মাহত হন মহাত্মা। সোদপুর আশ্রমে বসেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, আরও কয়েকদিন কলকাতাতেই থাকতে হবে। সৌহার্দের বাতাবরণ যতদিন না তৈরি হচ্ছে, ততদিন থেকে যাওয়ার পণ নিলেন গান্ধীজি। মহাত্মার এই সিদ্ধান্ত ভাবিয়ে তুলল দাঙ্গাবাজদের। দেশভাগের জল্পনা শুরু হতেই এই বাংলায় যে সাম্প্রদায়িক হিংসার বীজ বপন করা হয়েছিল, তা মহীরুহের আকার ধারণ করে সাতচল্লিশের জুলাই-অগস্টের শুরু থেকে। এক দিকে দেশ স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে, অন্যদিকে সেই দেশের শরীর দ্বিখণ্ডিত হয়ে রক্তাক্ত হচ্ছে। এমন ক্ষণে মহানগরের বুকে লাঠি হাতে হেঁটে বেড়ালেন গান্ধীজি।
১০ অগস্ট গান্ধীজি ঠিক করলেন কলকাতা শহর সরেজমিনে দেখবেন। বিশেষ করে হিংসাপ্রবণ এলাকায় যাবেন। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সেদিনই কলকাতার ভূতপূর্ব মেয়র সইদ মহম্মদ ওসমানের নেতৃত্বে একটি দল গান্ধীজির কাছে আসে। তাঁকে স্মরকলিপি দিয়ে অনুরোধ করে, তিনি যেন নোয়াখালি যাওয়ার আগে কলকাতার কয়েকটি উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শন করেন। এরপর দু’ঘণ্টা ধরে বৈঠক হয় পশ্চিমবঙ্গের প্রধানমন্ত্রী (তখন এই নামেই ডাকা হত) প্রফুল্ল ঘোষ ও তাঁর মন্ত্রিসভার সঙ্গে। উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সেক্রেটারি অন্নদাপ্রসাদ চৌধুরীও।
বৈঠক শেষে বেলেঘাটার আশ্রমে সন্ধ্যায় প্রার্থনা সভায় বক্তৃতা রাখেন গান্ধীজি। তিনি বলেন, কলকাতায় এসেই স্থির করেছি নোয়াখালি যাত্রা কিছুদিনের জন্য স্থগিত রাখব। কলকাতার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। কলকাতাকে স্বাভাবিক করতে সর্বতোভাবে সাহায্যের আশ্বাস পেয়েছি। আমি সারাজীবন দুই সম্প্রদায়ের সেবা করে এসেছি। স্বাধীনতার দোরগড়ায় এসে যদি দেখতে হয়, উভয় সম্প্রদায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, তাহলে আত্মোৎসর্গ করা ছাড়া উপায় নেই। এই উন্মত্ততার মধ্যে বাস করতে চাই না।
গান্ধীজি যখন আত্মোৎসর্গের কথা উচ্চারণ করেন, প্রার্থনা সভায় উপস্থিত অনেকেই ভাবলেন, তাহলে ফের অনশনে বসতে চলেছেন তিনি। জয়ধ্বনি শুরু করে জনতা। তাদের থামিয়ে ফের তিনি বলেন, সোমবারই আমার নোয়াখালি যাওয়ার কথা ছিল। মুসলিম বন্ধুগণের ইচ্ছায় কলকাতায় থাকছি। তাঁরা আশ্বাস দিয়েছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিকে আনবেন। এমতাবস্থায় যদি নোয়াখালিতে নতুন করে দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে আমার জীবনের অবসান হবে। বিহার নিয়েও গান্ধীজি এমন কথা বলেছিলেন। শহর ঘোরার পরামর্শ হিন্দুদের তরফ থেকেও এসেছিল সেদিন।
গান্ধীজি এর আগে একবার লিগ মন্ত্রিসভার আহ্বানে কলকাতার উত্তর ও উত্তর পূর্ব পরিদর্শন করেছিলেন, তখন তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে পারেননি অনেকে। জনতার কাছে খবর সেভাবে না পৌঁছনোয় গান্ধীজিকে চিনতেও পারেননি সেদিন অনেকে। এবার গান্ধীজির কলকাতা পরিদর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ পেতেই আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ে সেই খবর। ১০ অগস্ট কাতারে কাতারে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ বেলেঘাটায় রাত থেকে জমা হতে শুরু করে। পরের দিন, সোমবার সকালে সাজো সাজো রব। মনেই হচ্ছিল না, বেলেঘাটা চত্বরে কোনও চাপনাউতর পরিস্থিতি ছিল।
সোমবার গান্ধীজির পদযাত্রা শুরু হয় চিৎপুর রেলওয়ে ইয়ার্ড অঞ্চল দিয়ে। এই এলাকায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায় পাশাপাশি বসবাস করে আসছে বহুদিন ধরেই। এই দুই সম্প্রদায়ের এলাকা ঘুরে দেখেন গান্ধীজি। বিপুল মানুষের সমাগমে হিমশিম খেতে হয় মিলিটারিকে। এমনও দেখা গেল, মুসলিম এলাকায় বহু মুসলিম গান্ধীজির দর্শন পেতে গাড়ি আটকে রইলেন। তাঁকে সেই এলাকা থেকে ছেড়ে যেতে দিতে নারাজ তাঁরা। গাড়ি থামাতে বাধ্য হলেন গান্ধীজি। তাঁকে আরও অনেক জায়গায় যেতে হবে, এমন অনুরোধও করতে হল তাঁকে। গাড়ি যখন আবার ছেড়ে সামনের দিকে এগোয়, এক ব্যক্তি দৌড় দেন পিছু পিছু। কারণ, তিনি গান্ধীজির সাক্ষাৎ পাননি।
শুধু ওই ব্যক্তি পিছন পিছন ছোটেনইনি, ছুটছেন সাংবাদিক, ছুটছেন নিরাপত্তা রক্ষী, ছুটছেন নেতা-মন্ত্রীরাও। পশ্চিমবঙ্গের প্রধানমন্ত্রী প্রফুল্লের ঘোষের গাড়িও ছুটছে। চিৎপুর শেষে এবার পৌঁছলেন মানিকতলা লালাবাগান ও মানিকতলা পুলের কাছে। সেখানেও কিছুটা সময় কাটালেন তিনি। তারপর গেলেন বেলেঘাটায়। গান্ধীজির অপেক্ষায় কাতারে কাতারে মানুষ। শঙ্খ, উলু ধ্বনি দিলেন মহিলারা। কে হিন্দু, কে মুসলিম বোঝা দায়, শুধুই কালো মাথার ভিড়। বেলেঘাটায় হিন্দু-মুসলিম আলাদা আলাদা জায়গায় বাস করলেও, এ দিন সব একাকার। এমনও দৃশ্য দেখা গেল, হিন্দুর কাঁধে হাত রেখে এক মুসলিম যুবক ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন গান্ধীজিকে এক পলক দেখার জন্য।
কয়েক দিন আগে উন্মত্ত জনতার যে সাম্প্রদায়িক হিংসার সাক্ষী ছিল এই বেলেঘাটা, ১১ অগস্ট সেই বেলেঘাটাই ভাসল দুই সম্প্রদায়ের সৌহার্দের জোয়ারে। হিন্দু-মুসলমান হাতে হাত রেখে গান্ধীজির গাড়ি আটকানোর চেষ্টা করলেন। মিলিটারির প্রহরীরা তাঁদের সরাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। বেলেঘাটার পর ঘুরলেন মুসলিম প্রধান এলাকা এন্টালি, চিংড়িঘাটা, ট্যাংরা। তারপর ধর্মতলা মোড় হয়ে সার্কুলার রোড। শেষে গেলেন রাজাবাজারও।
গান্ধীজির এই যাত্রার পরই অসম্প্রীতির কালো মেঘ কাটতে থাকে কলকাতায়। মঙ্গলবার মুসলিম সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা শরণাপন্ন হন মহাত্মার। তারপর শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে শান্তি প্রচার শুরু করেন। হিংসার চাপা বাষ্প আস্তে আস্তে কাটতে শুরু করে। স্বাধীনতা দিবসের উদযাপনের প্রস্তুতি শুরু হতে দেখা যায় ইতিউতি। শহরের বুকে যে বস্তি সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনই একটি বস্তিতে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গান্ধীজি। তারপর এমনই স্পর্শকাতর হিন্দু বস্তিতেও থাকবেন বলে স্থির করেন তিনি। গান্ধীজি জানান, তাঁর এই অহিংস নীতি একটি কঠিন পরীক্ষা। এই পরীক্ষার উপরই ভারতের স্বাধীনতা-সৌধের ভিত্তিমূলের দৃঢ়তা বোঝা যাবে।
তথ্য সূত্র: অমৃতবাজার পত্রিকা, যুগান্তর পত্রিকা