JU Student Union Explained: রাজনীতির আঁতুড়ঘর যাদবপুর-প্রেসিডেন্সিতে কারা এই স্বাধীন-কালেক্টিভ? কী তাদের ইতিহাস?

Jadavpur University Student Politics: সালটা ১৯৭৭। নকশাল আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বাংলার ক্ষমতা বামফ্রন্টের হাতে। এই সময় যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়েও জোরদার হয়েছে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া। সূত্রের খবর, এই বছর যাদবপুরে তৈরি হয় ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্টস ফেডারেশন বা DSF।

JU Student Union Explained: রাজনীতির আঁতুড়ঘর যাদবপুর-প্রেসিডেন্সিতে কারা এই স্বাধীন-কালেক্টিভ? কী তাদের ইতিহাস?
গ্রাফিক্স -অভিজিৎ বিশ্বাস Image Credit source: TV-9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Aug 22, 2023 | 11:58 PM

কলকাতা: বাম না অতিবাম না মাওবাদী! ওরা কারা? প্রশ্নগুলো উঁকিঝুঁকি মারছে ৯ অগস্ট যাদবপুরের (Jadavpur University) প্রথম বর্ষের ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর থেকেই। প্রাথমিক তদন্তে ব়্যাগিংয়ের তত্ত্ব উঠে এলেও গভীরে কিন্তু প্রচ্ছন্ন রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে। কীসের রাজনীতি? ডান না বাম? সেই প্রশ্নের উত্তর আবার বেশ জটিল। অনেকে বলছেন, যাদবপুরে (Jadavpur) একটা নিজস্ব রাজনীতি আছে। এসএফআই, টিএমসিপি, এভিপির মতো ধ্রুপদী রাজনীতির ছত্রছায়ায় ওদের বেড়ে ওঠা নয়। আপাত দৃষ্টিতে বামমনস্ক মনে হলেও যাঁরা এই রাজনীতিটি করেন, তাঁরা নিজেদের ‘স্বাধীন’ বলে পরিচয় দেন। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, এনআরসি, জাতীয় শিক্ষানীতির বিরোধিতা এমনকী প্রবেশিকা পরীক্ষা তুলে নেওয়ার বিরোধিতা, সবক্ষেত্রে যাদবপুরের গর্জে ওঠার নেপথ্যে ওরাই। যাদবপুর-প্রেসিডেন্সিতে সিপিএম-এর ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের দাপট থাকলেও ওদের দাপট কিন্তু কম নয়। কিন্তু ওরা কারা? দেওয়ালে দেওয়ালে DSF, FAS, WTI-র পোস্টার আর স্লোগানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ ঢেকে যায়, সেই সব ছাত্র সংগঠন কি ভুঁইফোড় দল নাকি তার কোনও ইতিহাস আছে? উত্তর খুঁজতে গেলে চলে যেতে হবে গত শতাব্দীর সাতের দশকে।

সাল ১৯৭৭

নকশাল আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বাংলার ক্ষমতা তখন বামফ্রন্টের হাতে। এই সময় যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়েও জোরদার হয়েছে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া। সূত্রের খবর, ওই বছর যাদবপুরে তৈরি হয় ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্টস ফেডারেশন বা DSF। অন্যদিকে একই বছর প্রেসিডেন্সিতে তৈরি হয় প্রেসিডেন্সি কলেজ স্টুডেন্টস অ্যাশোসিয়েশন বা PCSA। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দুই সংগঠনই নকশালপন্থী ভাবধারায় বিশ্বাসী হলেও অনেক সময়েই মুখে নকশালপন্থী বলে নিজেদের পরিচয় দেয় না। অনেকে প্রকাশ্যে চারু মজুমদারের লাইনের সমালোচনাও করতেন। তাঁরা নিজেদের সংগ্রামী ছাত্র সংগঠন বা বিপ্লবী বাম (REVOLUTIONARY LEFT) বলতে পছন্দ করতেন। আবার মিডিয়া এদের নকশালপন্থী ছাত্র সংগঠন বলে এসেছে। 

সেই সময় থেকেই দুই নামজাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে DSF ও PCSA-এর দাপট। সূত্রের খবর, শুধু এই দুই কলেজ নয়, সংসদীয় বামদের বিরুদ্ধে গোটা রাজ্যেই তখন নানা প্রান্তে নানা কলেজে সেই সময় ৩০ থেকে ৩৫টি এই ধরনের ছাত্র সংগঠন তৈরি হয়। যাঁরা নিজেদের ‘বিপ্লবী বাম’ বলে। তবে সবথেকে বেশি দাপট ছিল যাদবপুর ও প্রেসিতে। সূত্রের খবর, এর মধ্যে বেশিরভাগ ১০ থেকে ১৫ বছরের বেশি টিকতে পারেনি। নেতারা কখনও মূল স্রোতের রাজনীতিতে ভিড়ে যায় কখনও আবার রাষ্ট্রীয় আক্রমণের মুখে পড়ে সংগঠন উঠে যায়। 

স্বাধীনদের উত্থান

অন্যদিকে আশির দশকের শুরু ও নব্বইয়ের দশকের একদম গোড়া থেকে আরও এক ধরনের সংগঠনের জন্ম হতে শুরু করে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে। সূত্রের খবর, ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সালের মধ্যে প্রেসিডেন্সিতে তৈরি হয় ইন্ডিপেনডেন্ট কনসোলিডেশন IC। যাদবপুরে উই দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট বা WTI। এই WTI এখনও যাদবপুরে সায়েন্স বিভাগের ক্ষমতায় রয়েছে। এরা নিজেদের স্বাধীন ছাত্র সংগঠন বলে দাবি করতে থাকে। সোজা কথায় ‘অ্যাপলিটিক্যাল’। তাদের একটাই কথা, বাইরের কোনও রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করব না। বাইরের কোনও রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী হব না। তবে শোনা যায় এদের অনেক নেতাই সেই সময় বাইরে কংগ্রেস করতেন। মিডিয়া এদের বামপন্থী, অতিবাম বললেও এরা কোনকালেই সেটা ছিলেন না বলে মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।  

এদিকে সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রভাব বাংলার রাজনীতিতেও প্রকট। মণ্ডল কমিশনের বিরোধিতা, রিজার্ভেশনের বিরোধিতা নিয়ে আন্দোলন চলছে বাংলায়। রাজনৈতিক পটচিত্র বদলাচ্ছে। এই সময় দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই স্বাধীনদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। তখনও কালেক্টিভ বলে রাজনৈতিক মার্কেটে কিছু আসেনি। খাতায় কলমে এরা স্বাধীন বলেই পরিচিত ছিল। 

উল্লেখ্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম জমানার শুরু থেকেই লড়াইটা ডিএসএফের সঙ্গে এসএফআইয়ের। আশির শেষের দিকে এসএফআইয়ের কাছে হেরে যায় ডিএএসএফ। কিন্তু, এই ডিএসএফ তখনও বামপন্থী। বিপ্লবী বাম বলতে পছন্দ করে। ছিল পিডিএসএফের লোকজনও। অন্যদিকে প্রেসিডেন্সিতে ৯০-এর মাঝামাঝি IC-র কাছে হেরে যায় PCSA। তারপর থেকে IC-র প্রাধান্য বাড়ে প্রেসিডেন্সিতে।

কালেক্টিভের উত্থান

সূত্রের খবর, ১৯৯৪ সালে সৌমেন্দ্রনাথ ঘোষ, পঙ্কজ মাইতিরা প্রেসিডেন্সিতে একটি গোষ্ঠী তৈরি করেন। সমস্ত চলতি আদর্শের বিরোধিতা করতে শুরু করে তাঁদের এই সংগঠন। কংগ্রেস থেকে বামদল, সবার বিরোধিতা। এরাই ‘কালেক্টিভ’। সূত্রের খবর, মুখে ওঁরা এই সংগঠনের নাম কখনওই খুব একটা আনেন না। নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে প্রেসিডেন্সিতে এদের ভালই দাপট ছিল। ২০০০ সালের শুরুর দিকে যাদবপুরের কিছু ছেলেমেয়ে ওঁদের সমর্থন করতে শুরু করেন। তৈরি হয় জোট। তৈরি হয় ‘ছাত্র আন্দোলন প্রস্তুতি’ বা CAP। এদিকে যাদবপুরে SFI এর কাছে ডিএসএএফ হেরে যাওয়ার পর থেকেই বিশেষত ১৯৯৪ সালের পর থেকে ডিএসএফ এর দখল নিতে শুরু করে কালেক্টিভ। অচিরেই মেজরিটি হয়ে ওঠে। এখনও একই চিত্র। তবে এখনও ডিএসএফের একাংশ বিপ্লবী বাম বলেই নিজেদের দাবি করে। সূত্রে খবর, এদের আবার যাদবপুরের সল্টলেক ক্যাম্পাসে ভাল ক্ষমতা রয়েছে। যাদবপুর আর্টসেও রয়েছে ডিএসএফ আর্টস নামে একটি বামপন্থী সংগঠন। 

এরইমধ্যে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে শুধু প্রেসিডেন্সিতে তৈরি হয় ফ্রিডম ফর ফ্রেশার্শ (FFF)। তৈরির কিছু বছরের মধ্যে উঠেও যায়। সূত্রের খবর, ২০০৬ সালে উঠে যায় CAP-ও। তারপর থেকে এই গোষ্ঠীর কোনও নাম নেই খাতায়-কলমে। বিভিন্ন পত্রিকা, বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে কাজ করে থাকে। লোকে বামপন্থী বলে চেনে কারণ বামপন্থীদের অনেক কথা, কাজের ধরনের সঙ্গে এদের কথা কাজ মেলে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এরা বাম বিরোধী। বিভিন্ন বিতর্কসভা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের অভ্যন্তরীণ জিবি মিটিংয়ে এরা সেটা প্রকাশ্যে বলে থাকে। 

কালেক্টিভের দখলে WTI- IC-FAS 

নব্বইয়ের দশকে শুরুর পর থেকে WTI আদর্শের দিক থেকে স্বাধীন থাকলেও ২০১০ সাল থেকে কালেক্টিভদের দৌরাত্ম্য বাড়ে। ২০১১ সাল থেকে পুরোটাই কালেক্টিভের দখলে চলে যায়। অন্যদিকে, নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে আইসিতে সংখ্যাগুরু কালেক্টিভ। ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আবার আইসিতে কালেক্টিভের খুব একটা দখল ছিল না। অতিবামদের দখল বাড়ে বলে শোনা যায়। ২০১০ সালে রাজ্যে পালাবদলের হাওয়ার মধ্যে পর আইসিতে ফের মেজরিটি হয় কালেক্টিভ।  

সূত্রের খবর, ২০০৫ সাল পরবর্তী সময়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হয় ফরাম ফর আর্টস স্টুডেন্টস বা ফ্যাস। কিছু বিক্ষুদ্ধ SFI, RSF ও কিছু বামপন্থী ছাত্র সংগঠন মিলে তৈরি করে এই সংগঠন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে কেউই FAS তৈরির ‘দায়’ নিতে নারাজ। এদিকে তৈরির পর প্রথম ৬ বছর কিন্তু ফ্যাসের দখল যায়নি কালেক্টিভের হাতে। বিপ্লবী বাম রাজনীতি বা সংসদীয় বামেদের বিরোধিতা সেখানে প্রবল। রাজ্যে তখন ক্ষমতায় সিপিএম। ২০০৮-০৯ সাল নাগাদ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন মোটামুটি শেষ। লালগড় চলছে। সূত্রের খবর, সেই সময় ফ্যাসে ঢোকে তৃণমূলের লোকজন। ২০১১ সালে তৈরি হল টিএমসিপি। তখন ফ্যাস ছেড়ে তৃণমূলের লোকজন চলে গেল টিএমসিপিতে। যাদবপুরে নিজেদের ক্ষমতা বাড়ল কালেক্টিভ। ফ্যাসের দখল নিয়ে ফেলল কালেক্টিভ। ইতিমধ্যেই ততদিনে যাদবপুরে বিপ্লবী বাম বা অতিবাম ছাত্র সংগঠনগুলির ক্ষমতা অনেকটাই বেড়েছে। তাঁরা ফ্যাসে শক্তি হারিয়ে খুব একটা আশাহত হল না। তবে এই ফ্যাসেরই মধ্যে থেকে আবার বর্তমান সময় পর্যন্ত কাজ করেছে পিডিএসএফ।

‘বদলে’ বিশ্বাসী যাদবপুর

তবে যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সি বিগত কয়েকদশকে কোনও সংগঠনের একাধিপত্য ছিল না। বাম ডিএসএফের ক্ষমতা তো নব্বইয়ের দশকের শেষেই তলানিতে। কখনও স্বাধীনরা ক্ষমতায়, কখনও সংসদীয় বাম বা এসএফআই ক্ষমতা। কিন্তু, রাজ্যে পালাবদল, হোক  কলরব আন্দোলন অনেক সমীকরণ বদলে দেয়। ২০১৭ সালে প্রথম এসএফআই কালেক্টিভকে হারিয়ে দেয় যাদবপুর আর্টসে। প্রেসিডেন্সিতেও এসএফআইয়ের কাছে হারতে শুরু করল স্বাধীনরা। ২০২০ সালে পুরো ধসিয়ে দিল। কিন্তু এখনও যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়রিং ও সায়েন্সের ক্ষমতা এই কালেক্টিভি ডিএএফ ও WTI এর হাতে।

স্বাধীন ছাত্র রাজনীতি নিয়ে প্রাক্তন ছাত্রনেতা ছন্দক চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “যাঁরা স্বাধীন সংগঠনগুলি করেন তাঁরা আসলে শাসকদলের বিরুদ্ধে। ২০১০ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে এখানে ছাত্ররা আটকে ছিল। ২০১৪ সালে যখন হোক কলরব আন্দোলন হয়েছিল তখনই এখানকার পড়ুয়ারাই ক্যাম্পাসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আসতে বাধ্য করেছিল। এবং এনআরসির সময় বাবুল সুপ্রিয়কে এখানে আসতে বাধ্য করে। তাই প্রতিটা রঙের শাসক এখানে এই মুক্তচিন্তার পরিবেশে বাধাপ্রাপ্ত হয়। কোনও একটা দল নয়, যেই শাসক শ্রেণিতে থাকে তাঁকে বাধাপ্রাপ্ত হতে হয়।”

এসএফআইয়ের রাজ্য সহ-সম্পাদক শুভজিৎ সরকার বলেন, “স্বাধীনরা আসলে কোনও রাজনীতি করে না। এরা মঞ্চ খুলে ছোটো ছেলেমেয়েদের মাথা খায়। বিপ্লবের স্বপ্ন দেখায়। তারপর খাদের কিনারায় ফেলে দিয়ে চলে যায়। এরা আবার মাঝেমাঝে নানা মুখোশ পরে। যাতে যাদবপুর, প্রেসিডেন্সিতে ঢুকতে পারে সে জন্য বামপন্থীদেরও মুখোশ পরে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে থাকে। কখনও পৃথিবীর পাঠশালা, ও কখনও আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি খুলে কাজ করে। আদপে এরা বিশ্বিবিদ্যালয়ের গণ্ডির বাইরে তৃণমূল ও বিজেপির সঙ্গে থাকে।”  

যাদবপুরের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নতুন সভাপতি রাজন্যা হালদার বলেন, “আমরা যখন ওই পড়ুয়ার মায়ের সঙ্গে কথা বলি তিনি আমাদের হাত ধরে বলেছেন দোষীরা যেন কড়া শাস্তি পায়। কালেক্টিভ হোক বা যাই হোক, বাম হোক বা অতিবাম হোক, তারা খুনি। তাঁদের ছেড়ে কথা বলা যাবে না।”