Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: পর্ব ১৩—প্রকৃতির মাঝে এ এক অন্য লাদাখ, দ্বিতীয় পর্ব
Ladakh Bike Trip From Kolkata: বাইকপ্রতি ২৯০ টাকার টোল মিটিয়ে ঝাঁ চকচকে সোলার লাইটের আলোয় খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট দিলাম। রাস্তার দু’পাশের গার্ডরেল, মাঝ বরাবর ডিভাইডারে লোহার জালের বেড়া, ঘন-ঘন মাইলস্টোনে কিলোমিটারের ইঙ্গিত আর তেলতেলে কালো পিচ... গাড়ির কাঁটা তখন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে।
বাইশে মে
সকালে যখন ঘুম ভেঙে উঠলাম, তখনও কেউ ওঠেনি। গেস্ট হাউজের একদম গা-ঘেঁষে দুরন্ত এক্সপ্রেস হুইসেল বাজিয়ে বিকট আওয়াজ করে বেরিয়ে গেল। বাইরে বেরিয়ে দেখি ছাদেই আবার তাঁবু খাটিয়ে আমাদের গ্রুপের মধ্যে দু’-তিনজন শুয়ে আছে। দেখে মনে হল, আগামী দিনগুলোর জন্য বোধহয় শুরুতেই একবার তাঁবু খোলা-পড়া প্র্যাকটিস চলছে। একটু বেলা বাড়তে সকলের ঘুম ভাঙছে দেখে, বাথরুম ফাঁকা না-পাওয়ার আশঙ্কায় সকালের শুভকাজটা সেরে নিলাম। এ দিকে, আটটা বাজতে না-বাজতেই গরম তার চরিত্র জানান দিতে শুরু করল। গতকাল বাবলাদা এই পরিস্থিতির কথা জানাতে রাতেই প্ল্যান হয়ে গিয়েছিল—আজ সকালে আর বের হব না। সকালের দিকে বাবলাদার বাড়ি ঘুরে টুকটাক বাইরের কাজ মিটিয়ে বিকেলের হাওয়া একটু নরম হলে রওনা দেওয়া যাবে। সেইমতো সবাই রেডি হয়ে বাবলাদার বাড়িতে পৌঁছলাম। চা-বিস্কুটের পালা সাঙ্গ করে সবাই গেল বাজারের দিকে। আমি আর দু’জন রয়ে গেলাম কারণ রুমে থেকে গোছগাছগুলো সেরে রাখতে হবে। সবাই যখন বাজারে গিয়েছে। আমরা যে যার মতো করে কালকের জামা-প্যান্টগুলো একটু ধুয়ে নিয়ে স্নান সেরে লাগেজ গোছানোয় মন দিলাম। কাজ শেষ হলে বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প করতে-করতে জেনেছিলাম লখনউ শহরটা সম্পর্কে। যা শুনলাম, মোটামুটি এইরকম…
প্রাচীন ও আধুনিকের মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা লখনউ শহর উত্তরপ্রদেশের বর্তমান রাজধানী। তেরো শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে দিল্লি সালতানাত, শারিকি সালতানাত, পনেরো শতকের মাঝামাঝিতে মুঘল শাসন ও পরবর্তীকালে অউধের নবাবদের সাম্রাজ্যের একটি মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই লখনউ। এখানে বেড়াতে-আসা মানুষ, বিশেষত ঐতিহাসিক নিদর্শনে আগ্রহীদের জন্য লখনউ তার বিস্ময়ের ডালি উজাড় করে রেখেছে। বড় ইমামবাড়া (‘ভুলভুলাইয়া’ নামে অতি পরিচিত), ছোটো ইমামবাড়া, রুমি দরওয়াজা, ছাত্তার মঞ্জিল, দিলখুশা কোঠির পরতে-পরতে যেমন পাওয়া যায় প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যের ছাপ, তেমনিই আম্বেদকর মেমোরিয়াল পার্ক, মেরিন ড্রাইভ (মুম্বইয়ের অনুকরণে গোমতী নদীর তীর বরাবর গড়ে ওঠা রাস্তা), কুকরেল ফরেস্ট রিজার্ভ অ্যান্ড পিকনিক স্পট (এশিয়ার সবথেকে বড়ো কুমির সংরক্ষণ), লা মার্টিনিয়ার স্কুল, লখনউ জু, স্টেট মিউজিয়াম ইত্যাদির মধ্যে আছে ব্রিটিশোত্তর আর্কিটেক্টের ছোঁয়া। অতীত কাল থেকেই সাহিত্য-সংষ্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে মুঘলাই ঘরানার খাওয়া-দাওয়ায় উত্তর ভারতের স্বর্গরাজ্যই বলা চলে এই লখনউকে।
বাইরের ওই আটচল্লিশের গরমে দাঁড়ানো দায় দেখে ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম। দুপুরের খাবার জুটল গোপীদা আসার পর, অনেকটা দেরি করে। ‘বড়া মঙ্গল’ থেকে আনা পুরি-ছোলা আর মুড়ি খেয়ে আবার লম্বা ঘুম। ‘বড়া মঙ্গল’ একটি হিন্দি শব্দ। মে-জুন মাসে হনুমান জয়ন্তী উপলক্ষে শুধুমাত্র লখনউয়ে পালিত হওয়া এক অনুষ্ঠান। হনুমানজির ভক্তদের উদ্যোগে সারা লখনউয়ের রাস্তা জুড়ে ভান্ডারা লাগিয়ে শরবত, লস্যি, পুরি-ছোলা, সুজি-মিষ্টির এলাহি বিতরণ।
ঘুম ভাঙতে বেজে গেলো ছ’টা। তখনও বেলা পড়েনি। এবার রওনা দেওয়ার পালা। সবার গোছগাছ শেষ হলে ঘর ভাড়া মিটিয়ে ঘর ছাড়তে-ছাড়তে আরও ঘন্টা দেড়েক দেরি হয়ে গেলো। সকলকে বিদায় জানিয়ে আমরা দশজন শহর ছেড়ে গিয়ে উঠলাম লখনউ-আগ্রা এক্সপ্রেস ওয়েতে। ৩০২ কিলোমিটারের ভারতের সবথেকে বড় এবং ওয়েল ডেকোরেটেড টোল কন্ট্রোল্ড এক্সপ্রেসওয়ে। এক্সপ্রেসওয়ে এখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি, যদিও রাস্তার কাজ পুরোপুরি শেষ। শুরুর দিকে রাস্তায় আলো নেই। তাই গাড়ির হেডলাইটের ভরসায় বেশ কিছুটা যাওয়ার পর এল প্রথম টোলপ্লাজা। বাইকপ্রতি ২৯০ টাকার টোল মিটিয়ে ঝাঁ চকচকে সোলার লাইটের আলোয় খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট দিলাম। রাস্তার দু’পাশের গার্ডরেল, মাঝ বরাবর ডিভাইডারে লোহার জালের বেড়া, ঘন-ঘন মাইলস্টোনে কিলোমিটারের ইঙ্গিত আর তেলতেলে কালো পিচ… গাড়ির কাঁটা তখন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। একে অপরের থেকে দূরত্বও বাড়া-কমা করতে লাগল। এভাবেই চলতে-চলতে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পরে এল প্রথম ইন্টারস্টেশন: উন্নাও। মাত্র কয়েক ঘন্টায় একে-একে কান্নাউজ, ইটাবা পেরিয়ে রাত একটা নাগাদ ফিরোজাবাদে এসে দাঁড়ালাম। এক্সটেনশনের নীচে প্রায় তৈরি হয়ে যাওয়া পেট্রোল পাম্প আর রেস্টিং প্লেসগুলো দেখা যাচ্ছিল, যা আর কিছু দিনের মধ্যেই ব্যস্ত হয়ে উঠবে পথচলতি মানুষের প্রয়োজনে। একটানা বাইক চালিয়ে ঘুমে চোখ বুজে আসছিল। এখুনি রেস্ট না নিলে অঘটনের সম্ভাবনাও তাই এড়াতে পারলাম না। সেই কারণে কাট-আউটের পাশেই বাইকগুলোকে স্ট্যান্ড করে একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। সোঁ-সোঁ আওয়াজ করে চার চাকাগুলো ঝড়ের বেগে এসে মুহূর্তেই মিলিয়ে যাচ্ছিল। বেশিক্ষণ চোখ বুজে থাকা গেল না। নানারকমের ভুলভাল চিন্তায় চমকে-চমকে উঠছিলাম। ঘুম ভেঙে গেল। আড়াইটে নাগাদ চোখে-মুখে জল দিয়ে আবার গাড়ি ছাড়লাম। ভোর হওয়ার আগেই শেষ টোলপ্লাজায় চেক আউট করে আগ্রা রিং রোড ধরলাম। এই রিং রোড গিয়ে পড়েছে যমুনা এক্সপ্রেস ওয়েতে। আগ্রা শহরের যানজট অনেকটাই কম হয় দুই এক্সপ্রেসওয়ের এই কানেক্টরের কারণে। পেরিয়ে আসা রাস্তায় যেহেতু এখনও কোনও ফুয়েল স্টেশন তৈরি হয়নি তাই রিং রোড থেকে কিছু পরেই নীচে নেমে গেলাম বাইকে তেল ভরার জন্য। এখানে একটা কথা বলা দরকার। আমাদের এই রাতে বাইক চালানোর ডিসিশনটা একটু ভুলই হয়েছিল, আমাদের শরীর রাতে ঘুমনোর জন্যই অভ্যস্ত। তাই আপনি যতই সকালবেলা ঘুমোন না কেন, রাতের ঘুম খুবই দরকার। দিনে প্রায় ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রার গরমের জন্য আমরা রাতে ড্রাইভ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
এরপরে আমরা সবাই গাড়িতে তেল ভরে যমুনা এক্সপ্রেসওয়েতে উঠলাম। এই রাস্তাটি ২০১২ সালে অগস্ট মাসে তৈরি হয়েছিল দিল্লি আর আগ্রার যোগাযোগের সময় কমানোর জন্য। এটি ১৬৫ কিলোমিটারের সিমেন্টের তৈরি ছয় লেনের রাস্তা। রিং রোডে যখন আমরা তেল ভরছিলাম, তখন শুনতে পেলাম হঠাৎই ময়ূরের ডাক। সামনের ছোট ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বার করতে গিয়ে ময়ূর উঠে পড়ল গাছের ডালে। তাই আর তার ছবি তোলা হল না। সেখানকার পেট্রোল পাম্পের এক কর্মচারী বললেন, এখানে প্রায় সব সময় ময়ূরের ডাক শোনা যায়। তারা বেশিরভাগ সময়ই গাছে থাকে, আর দিন-রাতে ডাকাডাকি করে থাকে। রিং রোডের টোলপ্লাজা থেকে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ের দূরত্ব প্রায় ৩৪ কিলোমিটার। এই ৩৪ কিলোমিটার রাস্তা পার হতে প্রায় এক ঘন্টা সময় লেগে গেল। এবার আবার যমুনা এক্সপ্রেসওয়ের টোলপ্লাজা এসে হাজির। মনে হয় সারা ভারতের এই তিন জায়গাতেই বাইকের জন্য টোল দিতে হয়। যাই হোক, সবাই একে-একে ২০৫ টাকা করে টোল দিলাম। এই গরমের মধ্যে অনবরত বাইক চালানোর ফলে আমাদেরও শরীর একেবারে ছেড়ে দিয়েছিল এবং বাইকের চেন ঘ্যাস-ঘ্যাস আওয়াজ করে যেন একটু বলতে চায়, এবার একটু জিরিয়ে নেওয়া দরকার। আরও মিনিট চল্লিশে চলার পর পৌঁছে গেলাম সেই এক্সপ্রেসওয়ের উপর তৈরি প্রথম পেট্রোল পাম্প এবং সংলগ্ন ধাবায়। একে-একে পিছনে ফেলে এলাম মথুরা বৃন্দাবন যাওয়ার কাট-ডাউন রাস্তা।
আমাদের গ্রুপে তিনটে বাইক ১০০ সিসির কম থাকায় এতটা দূরত্ব অতিক্রম করে একটি বাইকের গিয়ার বক্সে সমস্যা দেখা দিল। এই প্রবলেম হওয়ার দু’টি কারণ। একটি হল একসঙ্গে এতটা দূরত্ব অতিক্রম করা, অন্যটি হল দ্রুত গতিতে চালানো। তাই বেশি টেনশন না নিয়ে পাশের ধাবায় টক দই, সবজি-সহ আলু পরোটা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ধীরে-ধীরে। একটু যেতেই ঘনঘন জল পিপাসায় আমরা প্রত্যেককেই অস্থির হয়ে উঠলাম। চারপাশে এতটাই লু বইছে যে, শরীরের যেটুকু খোলা অংশ রয়েছে, সেখানেই মনে হচ্ছে আগুনের হালকা অনুভব করছি। আশেপাশে কোনও গাছপালা নেই যে, একটু তার নীচে দাঁড়াব। ধাবার ওয়াটার কুলার থেকে পাঁচ মিনিট আগের ভরা ঠান্ডা জল এতটাই গরম হয়ে গিয়েছিল যে, তাতে চা দিলে মনে হয় লিকার চা হয়ে যাবে। এই গরম জলের মধ্যেই আমরা ওআরএস দিয়ে তা খাবার চেষ্টা করি। বেলা দশটাতেই দুপুর একটার মতো রোদ আর গরম। তারপর আরও এক ঘণ্টা যাওয়ার পর গ্রেটার নয়ডার কিছু আগে বাঁ দিক নিতে হবে বলে একে-একে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। গ্রেটার নয়ডা ঢোকার কিছু আগে রাস্তার দু’পাশ জুড়ে শুরু হল স্পোর্টস কমপ্লেক্স। তারই একদিকে চোখ পড়তে দেখলাম বড়-বড় অক্ষরে লেখা ‘বুদ্ধা ইন্টারন্যাশনাল সার্কিট’। ২০১১তে তৈরি হওয়া ভারতের একমাত্র ফর্মুলা ওয়ান রেসিং বা মোটর রেসিং সার্কিট। নয়ডার কাছেই আমরা ঠিক করলাম আজকের দিনটা এখানে স্টে করব, তার কারণ সারারাত ঘুম না হওয়ায় আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। আমাদের গ্রুপের এক দাদার বন্ধু এখানে থাকে, তাই সেই-ই ব্যবস্থা করে দিল দু’টি রুমের। বাইরে এতটাই গরম যে, এসি ১৭য় দিয়েও ঘর ঠান্ডা হতে সময় নিল প্রায় এক ঘণ্টা। এরই মধ্যে আমরা এক-এক করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম এবং নরম বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রামও নিয়ে নিলাম। বিকেলের সময় দু’জন গাড়ি ঠিক করতে বেরিয়ে পড়ল। আর আমরা বসে ঠিক করতে থাকলাম আজকের প্ল্যান। গতকাল সারারাত ড্রাইভ করে যা অবস্থা হয়েছিল, তাতে শেষমেশ ঠিক করলাম ভোরবেলায় আমরা বেরবো। তাই আর দেরি না করে সন্ধ্যেবেলায় দুপুর এবং রাতের খাবার খেয়ে রাত আটটার মধ্যে আমরা শুয়ে পড়লাম। রাতেই আমরা হোটেলের ভাড়া মিটিয়ে নিই। ৫০০ টাকা করে এক-একটা রুম। নয়ডার বুকে দু’টো রুম হাজার টাকা—খুবই কম।
… আগামী পর্বে থাকবে অমৃতসর হয়ে জম্বু-কাশ্মীরে প্রবেশ