Jhalda municipality: ঝালদায় আজ ‘পূর্ণিমা’, যখন তখন ঘনাতে পারে অমাবস্যা, বলছে ইতিহাস
Jhalda Municipality: ঝালদার পুরসভায় যেমন রাতারাতি পালাবদল হতে দেখা যায়, তেমনই কাউন্সিলরদেরও রং বদলায় যখন-তখন।
ঝালদা: “আদালতকে একটু সম্মান করুন।” শুক্রবার রাজ্যকে কার্যত ভর্ৎসনার সুরে মন্তব্য করেছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিংহ। প্রেক্ষাপট, বহু আলোচিত ঝালদা পুরসভা। গত কয়েক মাসে ঝালদা পুরসভা নিয়ে যে জট দেখা গিয়েছে, তা উত্তরোত্তর জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। ঘনঘন পালাবদল আর রাজনৈতিক চাপানউতরে খবরের শিরোনামে থেকেছে ঝালদা পুরসভা। জল গড়িয়েছে আদালতেও। তবে, সমস্যার কোনও সমাধান সেভাবে হয়নি। আপাতত, আদালতের নির্দেশে ঝালদার পুরসভার প্রধান পদে বসছেন প্রয়াত কংগ্রেস কাউন্সিলর তপন কান্দুর স্ত্রী পূর্ণিমা কান্দু। কিন্তু, ঠাকুর থাকবে কতক্ষণের মতো এই পদের পালাবদল রাতারাতি যে হবে না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না ঝালদাবাসী। সম্প্রতি ঘটনাক্রম এবং ঝালদা পুরসভার এক দশকের ইতিহাসের সাক্ষী থেকে এই কথা বলছেন তাঁরা।
ইতিহাসের পাতা উল্টে, যদি ফিরে যাওয়া যায় ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতা আসার আগে, অর্থাৎ ২০১০ পুরনির্বাচনে, সেখানে মোট ১২ আসনের ঝালদা পুরসভার সিপিএম ৩টি, ফরওয়ার্ড ব্লক ২টি, বাম-সমর্থিত নির্দল ১টি, কংগ্রেস ৩টি এবং নির্দল ৩টি আসন পেয়েছিল। বোর্ড গঠন করেছিল বামফ্রন্ট। পুরপ্রধান হন সিপিএম-এর পঙ্কজ মণ্ডল। এরপর ২০১১-তে বিপুল জনমত নিয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। তার ঠিক দেড় বছরের মধ্যে অঙ্ক পাল্টে যায় ঝালদা পুরসভার। যে পুরসভায় তৃণমূল দাঁত ফোটাতে পারেনি, ক্ষমতা আসার পর তৃণমূলের ঝোলায় ৩ কাউন্সিলর। কংগ্রেসের প্রদীপ কর্মকার-সহ ৩ জন তৃণমূলে যোগ দেন। বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাবে পুরপ্রধানের কুর্সি যায় পঙ্কজ মণ্ডলের। সেই জায়গায় বসেন সদ্য তৃণমূলে যোগ দেওয়া প্রদীপ কর্মকার।
কণ্টকময় কুর্সিতে বসেও স্বস্তিতে ছিলেন না প্রদীপ কর্মকার। ২০১৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা এবং দুর্নীতির অভিযোগ এনে মহাকুমাশাসককে অনাস্থার চিঠি দেন নির্দলের সুরেশ আগরওয়াল-সহ ঝালদা পুরসভার ৬ কাউন্সিলর। যার মধ্যে ওই চিঠিতে সই করেছিলেন তৃণমূলের ২ কাউন্সিলর। বিরোধীদের অভিযোগ, অনস্থা প্রস্তাব আসা সত্ত্বেও আস্থা ভোট করানোর কোনও উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি পুরপ্রধান প্রদীপ কর্মকারকে। নিয়ম অনুযায়ী, প্রধান আস্থাভোট না ডাকলে, উপপ্রধান ডাকতে পারেন। কিন্তু সেই উপপ্রধানও আস্থাভোট ডাকেননি বলে অভিযোগ ওঠে। এরপর অনাস্থা প্রস্তাবে প্রাক্তন পুরপ্রধান পঙ্কজ মণ্ডল, নির্দলের কালীপদ চট্টোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের মনোজ সাউ স্বাক্ষর করলে আস্থা ভোট ডাকতে বাধ্য হন পুরুলিয়ার মহাকুমাশাসক (পশ্চিম)।
২০১৪ সালের ৪ জুলাই আস্থাভোটে ১২ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ১০ জনই পুরপ্রধান প্রদীপ কর্মকারের বিরুদ্ধে ভোট দেন। আস্থাভোটে যোগ না দিয়েও কুর্সি খোওয়াতে হয় প্রদীপকে। নির্দলের সুরেশ আগরওয়ালকে পুরপ্রধান করা হয়। মজার বিষয়, বামফ্রন্টের পঙ্কজ কুমারকে পুরপ্রধানের পদ থেকে প্রদীপ কর্মকারের নেতৃত্বে যাঁরা সরালেন, তাঁরাই আবার প্রদীপ কর্মকারকে সরালেন পঙ্কজ কুমারের নেতৃত্বে। সে দিন সুরেশবাবু বলেছিলেন, “এখন প্রধানের দায়িত্ব শুধু উন্নয়নে নজর দেওয়া। যে সমস্ত কাজ বাকি আছে, দ্রুত শেষ করতে হবে।” সত্যি কি পেরেছিলেন? কারণ, ছয়-সাত মাসের মধ্যেই বেজে যায় ফের পুরনির্বাচনের দামামা।
ঝালদার পুরসভায় যেমন রাতারাতি পালাবদল হতে দেখা যায়, তেমনই কাউন্সিলরদেরও রং বদলায় যখন-তখন। ২০১৫ পুরনির্বাচন তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। যেমন, কালীপদ চট্টোপাধ্যায়। টিকিট পাননি বলে সিপিএম-এর ঝালদা লোকাল কমিটির সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধেই নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কালীপদ চট্টোপাধ্যায়। ভোটের পরে আবার সিপিএম-এ ফিরে আসেন তিনি। সেই সময় দলবদলের তালিকায় পড়বেন প্রাক্তন পুরপ্রধান প্রদীপ কর্মকারও। একদা কংগ্রেসের প্রদীপ রাজ্যে পালাবদল হতে তৃণমূল শিবিরে আস্তানা নেন। পুরপ্রধানও হন এবং পদও খোয়ান। কিন্তু পুরভোটের আগে ফের কংগ্রেসে ফিরে আসেন প্রদীপ কর্মকার। আরও এক প্রাক্তন পুরপ্রধান পঙ্কজ সরকার ভোটের সময় দলীয় প্রতীক ছেড়ে বাম সমর্থিত নির্দলে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনকী বর্তমানে পুরপ্রধান প্রয়াত তপন কান্দুর স্ত্রী পূর্ণিমা কান্দু ২০১৫ নির্বাচনে ফরওয়ার্ড ব্লকের হয়ে ভোটে লড়েছিলেন। তাঁর স্বামী তপন কান্দুও। তাই পুর-পালাবদলের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের দলবদলও গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে ঝালদাবাসীর।
২০১৫ সালেও তৃণমূলের রাজ্যে উলটপূরাণ ফল করে দেখাল ঝালদা। লোকসভায় ভাল ফল করলেও পুরনির্বাচনে ঝালদার ১২টা ওয়ার্ডের মধ্যে ৮টাতেই জামানত জব্দ হয় তৃণমূলের। নেপাল মাহাতোর গড় হিসাবে পরিচিত ঝালদায় কোনওক্রমে ৩টি আসন পায় বামেরা। সেবার ৭টি আসন পেয়ে একক ক্ষমতা দখল করে কংগ্রেস। কিন্তু বোর্ড গঠন করলেও এক বছরের মাথায় নেপাল-গড়ে পালাবদলের হাওয়া ওঠে একদা তৃণমূলের যুব সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল নেতা (বর্তমানে বিজেপি বিধায়ক) শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে। ভরা বাজারেও ঝালদা পুরসভায় দাঁত ফোঁটাতে না পারা ছিল তৃণমূলের প্রেস্টিজ ইস্যু। বছর ঘুরতেই কংগ্রেসের ৪, ফরওয়ার্ড ব্লকের এক এবং দুই নির্দল কাউন্সিলরকে পকেটে পুরে বোর্ড গঠন করে তৃণমূল। সেই নির্দল সুরেশ আগরওয়াল তৃণমূলে যোগ দিয়ে ফের পুরপ্রধান হন। ২০১৭ সালে সুরেশের বিরুদ্ধে আরও একবার অনাস্থা প্রস্তাব আনে বাম-কংগ্রেস-সহ তৃণমূলেরই কয়েকজন কাউন্সিলর।
২০২২ পুরনির্বাচনেও ঝালদায় আস্ফালন দেখাতে পেরেছিল নেপাল মাহাতোর দল। তৃণমূল ও কংগ্রেস পাঁচটি এবং নির্দল দুটি আসন পেয়ে ত্রিশঙ্কু তৈরি হয় ঝালদা পুরসভায়। কিন্তু বোর্ড গঠন করতে কংগ্রেসকে বেগ পেতে হয়। তারই মধ্যে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন সদ্য কংগ্রেস কাউন্সিলর তপন কান্দু। তারপর থেকেই নতুন করে মোড় নেয় ঝালদা পুরসভার চিত্রনাট্য। তৃণমূল বোর্ড গঠন করে। কিন্তু তার বিরোধিতা করে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আসে কংগ্রেস এবং নির্দল। তলবি সভায় তৃণমূলের পুরপ্রধান অপসারিত হয়। কিন্তু মাথার উপর একাধিকবার প্রশাসক বসিয়ে দেয় তৃণমূলের সরকার। যা নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়। আদালতকেও একাধিকবার হস্তক্ষেপ করতে হয়। তারপরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়ে এতটাই চরমে ওঠে যে রাজ্যের উদ্দেশে আদালতকে বলতে শোনা যায়, পরাজিত দলের প্রতিনিধিকেই কেন বারবার মাথার উপর বসানো হচ্ছে।
আদালতের হস্তক্ষেপে আপাতত স্থিতাবস্থায় ঝালদা পুরসভা। পুরপ্রধান পদে পূর্ণিমা। কিন্তু, অমাবস্যা আসতে আর কতক্ষণ? কারণ, ঝালদা পুরসভার ‘ডিএনএ’-ই যে আলাদা।